ফেসবুক জায়েদ খানদের ‘মৃত’ দেখাল কেন

জায়েদ খান, তসলিমা নাসরিন ও জিয়াউল হক পলাশসহ সুপরিচিত অনেক বাংলাদেশি ব্যবহারকারীর ফেসবুক প্রোফাইলে তাঁদের ‘মৃত’ দেখানো হয় সম্প্রতি
 ছবি: ফেসবুক থেকে

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন তত দিনে শেষ হয়েছে। তবে সাধারণ সম্পাদক পদের নাটকীয়তা শেষ হয়নি। কখনো জায়েদ খান, আবার কখনো নিপুণ আকতার। আদালতের রিটের পর এল পাল্টা রিট। স্বাভাবিক কারণেই জায়েদ তখন আলোচনার তুঙ্গে। ঠিক এমন সময় তাঁকে নিয়ে শুরু হলো ভিন্ন আলোচনা। জায়েদ খান নাকি আর নেই। অন্তত তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল তা-ই বলছে।

এ প্রতিবেদন লেখার সময় জায়েদ খান দিব্যি বেঁচেবর্তে ছিলেন। অথচ গত ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে ‘রিমেম্বারিং’ শব্দটি দেখা যায়, যা দিন তিনেক আগেও ছিল। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে গত শনিবার সন্ধ্যায় জায়েদ খান বলেন, ‘এই নিয়ে তিনবার আমার প্রোফাইলের এমন দশা হলো। নির্বাচনের কারণে কেউ বারবার রিপোর্ট করে কাজটা করেছে। আমি যেন ফেসবুকে কিছু বলতে না পারি, সেটাই ছিল উদ্দেশ্য।’

কেবল জায়েদ নন, নবাগত চলচ্চিত্রশিল্পী হুমায়রা সুবহা, টিভি অভিনেতা ও নির্মাতা জিয়াউল হক পলাশ, লেখিকা তসলিমা নাসরিনসহ সুপরিচিত অনেক বাংলাদেশি ব্যবহারকারীর ফেসবুক প্রোফাইলে ভুলক্রমে তাঁদের ‘মৃত’ দেখানো হয়েছে। এতে তারকাদের মৃত্যুর ভুল সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। গত দুই মাসে এই ভুলের হার নজরে এসেছে বেশি।

মৃত ব্যক্তির স্বজনের অনুরোধে প্রোফাইলে ‘রিমেম্বারিং’ শব্দটি যোগ করে থাকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখে ভার্চ্যুয়াল জগতেও এটাকে ‘মেমোরিয়ালাইজেশন’ অথবা স্মরণ কিংবা স্মৃতিচারণার জায়গা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে স্বজন ছাড়াও যে কেউ ফেসবুকের একটি সাদামাটা ফরম পূরণ করে মেমোরিয়ালাইজেশনের অনুরোধ জানাতে পারেন। সঙ্গে এমনকি ভুয়া শোক সংবাদ যুক্ত করে দিলে সে অনুরোধ গ্রহণও করছে ফেসবুক।

বিশেষজ্ঞ মত হলো, প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত অনিরাপদ এবং এতে ফেসবুকের দায়িত্বহীনতাও রয়েছে। এদিকে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মস বলছে, বিষয়টি তারা অবগত এবং সমস্যা সমাধানে কাজ করছে।

কী এই মেমোরিয়ালাইজেশন

কোনো ফেসবুক ব্যবহারকারীর মৃত্যুর পর তাঁর অ্যাকাউন্টের কী হবে, তা আগেভাগেই ঠিক করে দেওয়া যায় মেমোরিয়ালাইজেশনের মাধ্যমে। ব্যবহারকারী চাইলে মৃত্যুর পর তাঁর অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে মুছে ফেলবে ফেসবুক। আবার চাইলে স্বজনদের মধ্যে কাউকে ঠিক করে দিতে পারেন, যিনি মৃত্যুর পর ওই অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেবেন। এই নির্বাচিত স্বজনকে বলা হয় ‘লিগ্যাসি কন্টাক্ট’।

মেমোরিয়ালাইজড অবস্থায় ফেসবুক বন্ধুরা মৃতের টাইমলাইনে পোস্ট করতে পারেন। অবশ্য সেটা পূর্বনির্ধারিত প্রাইভেসি সেটিংসে থাকলে তবেই। আর লিগ্যাসি কন্টাক্ট তাঁর মৃত স্বজনের হয়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করতে পারেন, কোনো বন্ধুর পোস্ট সবার ওপরে (পিন) রাখতে পারেন, সে সঙ্গে প্রোফাইল ও কভার ছবি বদলাতে পারেন।
যে কেউ ফেসবুকে মৃত্যু রিপোর্ট করতে পারেন?
প্রক্রিয়া অনুযায়ী, কারও মৃত্যু হলে পূর্বনির্ধারিত লিগ্যাসি কন্টাক্ট তা ফেসবুককে জানাবেন। এরপর ফেসবুক সে অ্যাকাউন্ট মেমোরিয়ালাইজ করে প্রোফাইলে ‘রিমেম্বারিং’ উল্লেখ করে দেয়। তবে ব্যবহারকারী যদি আগে থেকে লিগ্যাসি কন্টাক্ট ঠিক না করে দেন? সমস্যার শুরু সেখানেই।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় গায়ক নোবেলের ফেসবুক প্রোফাইলেও ‘রিমেম্বারিং’ লেখা ছিল

লিগ্যাসি কন্টাক্ট ঠিক করা না থাকলে কোনো ব্যবহারকারীর মৃত্যুসংবাদ ফেসবুককে জানাতে পারেন যে কেউ। সে ক্ষেত্রে একটি অনলাইন ফরম পূরণ করতে হয়। কে মারা গেছেন, কবে মারা গেছেন, আর মৃত্যু প্রমাণ করে—এমন কোনো নথির স্ক্যান করা কপি জমা দিতে হয়। সে নথি হতে পারে পত্রিকায় প্রকাশিত শোক সংবাদ, ডেথ সার্টিফিকেট, মেমোরিয়াল কার্ড বা এমন কোনো নথি, যা মৃত্যু প্রমাণ করে। সে নথি আসল না নকল, তা যাচাই করার মতো যথেষ্ট প্রযুক্তি বা লোকবল ফেসবুকের কাছে নেই।
ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এভাবে মেমোরিয়ালাইজড হওয়ার সমস্যা হলো ব্যবহারকারী জীবিত থেকেও তা ব্যবহার করতে পারেন না। কোনো কিছু পোস্ট করা সম্ভব হয় না। অন্তত ভুলটি ফেসবুকের নজরে আসার আগপর্যন্ত তো বটেই।

ফেসবুকের মেমোরিয়ালাইজেশনের প্রক্রিয়াটি প্রথম আলোকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামের কম্পিউটারবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক এবং বিজ্ঞান লেখক ড. রাগিব হাসান। তিনি আরও বলেন, ফেসবুকের বাংলাদেশসংক্রান্ত রিপোর্ট স্থানীয়ভাবে যাচাই করা হয় না। সম্ভবত তাদের কোনো কেন্দ্রীয় মডারেশন টিম কাজটি করছে, যাদের লোকবল অপ্রতুল। এ কারণেই সম্ভবত খরচ বাঁচাতে পুরো কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুল দিয়ে করা হচ্ছে, যা আসল আর ভুয়া শোক সংবাদের পার্থক্য ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য নানা তারকার অ্যাকাউন্ট লক্ষ্য করে যে কেউ সহজেই তাঁর মৃত্যুর ভুয়া খবর ফেসবুকে রিপোর্ট করে তাঁদের অ্যাকাউন্ট মেমোরিয়ালাইজড করে ফেলতে পারছে। অ্যাকাউন্ট হ্যাক করারও কোনো দরকার নেই এখানে। বেশ কয়েকজনে মিলে মৃত্যুর ভুয়া রিপোর্ট করলেই ফেসবুক জীবিত মানুষকে মৃত ঘোষণা করে দিচ্ছে।’

২০১৬ সালের নভেম্বরে একসঙ্গে প্রায় ২০ লাখ ব্যবহারকারীকে প্রোফাইল মেমোরিয়ালাইজেশন মোডে চলে যায়। মার্ক জাকারবার্গের প্রোফাইলেরও একই দশা হয়েছিল

ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট ভুল করে মেমোরিয়ালাইজড হলে কী সমস্যা হতে পারে, সে সম্পর্কে রাগিব হাসান বলেন, এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যাটি আসলে ফেসবুকের ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতা। কারণ, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তারা খুব অবহেলার সঙ্গে চালাচ্ছে, যার ফলাফল ভিকটিমের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। তাদের এই ফরমসহ পুরো রিপোর্টিং সিস্টেমেই যাচাই-বাছাই করার কোনো বালাই নেই।

একাধিক রিপোর্ট এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারা অ্যাকাউন্টকে মৃত ঘোষণা করে দিচ্ছে। আর ফেসবুক (মেটা) বিদেশি প্রতিষ্ঠান বলে এবং বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা বা অফিস না থাকায় ভিকটিমরা স্থানীয়ভাবে প্রতিকারও নিতে পারছেন না। ফেসবুক পুরোপুরি বাংলাদেশের আইনের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে এ–জাতীয় সামাজিক মাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

তাহলে সমাধান?

এ সমস্যার সমাধানে কাজ করছে বলে জানিয়েছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মস। প্রথম আলোকে প্রতিষ্ঠানটির এক মুখপাত্র বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি সমস্যা আমাদের নজরে এসেছে, যেখানে অনিচ্ছাকৃতভাবে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট মেমোরিয়ালাইজড হচ্ছে। আমাদের কর্মীরা সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। এদিকে আমাদের কাছে যে অ্যাকাউন্টগুলো রিপোর্ট করা হয়েছিল, সেগুলো ইতিমধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

এমন সমস্যা এড়ানোর উপায় হিসেবে আগে থেকেই কাউকে লিগ্যাসি কন্টাক্ট ঠিক করে রাখার পরামর্শ দেন রাগিব হাসান। জায়েদ খান অবশ্য বলেছেন, আগে একটি লিগ্যাসি কন্টাক্ট ঠিক করা ছিল, তবে ফেসবুক থেকে সেটি আপডেট করতে বলা হয়েছে।

ফেসবুকের মেমোরিয়ালাইজেশন সুবিধাটি চালু হয় ২০০৯ সালে। তবে শুরুতে মৃত্যুর পর অ্যাকাউন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে ফেলার সুযোগ ছিল না। সেটি চালু হয় ২০১৫ সালে। শুরু থেকেই ফিচারটির অপব্যবহার দেখা গিয়েছে। আর বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা যায় ২০১৬ সালের নভেম্বরে। মেমোরিয়ালাইজেশন প্রক্রিয়ার ত্রুটিতে ফেসবুকে একসঙ্গে বহু ব্যবহারকারীকে মৃত দেখানো হয়। আর কী বিড়ম্বনা দেখুন, সে তালিকায় ছিলেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী খোদ মার্ক জাকারবার্গ।