পৃথিবীতে আলোচিত বিষয় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। এমন ব্যবহারে সফলতার দিক যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি ক্ষতির সম্মুখীনও হচ্ছে মানুষ। তরুণ প্রজন্ম মা–বাবাকে ধোঁকা দিয়ে ডুবে থাকছে ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগলে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে নির্জন স্থানে বসে স্মার্টফোনে খেলছে গেমস। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যস্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
শৌখিনতা পূরণ করতে গিয়ে অভিভাবক যেন নিজ সন্তানদের হাতে অজান্তে তুলে দিচ্ছে স্মার্টফোন। অজান্তেই সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের হিসাবেই ফেসবুক ব্যবহার করছে প্রায় তিন কোটি মানুষ। বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীর শতকরা ৯৩ ভাগের বয়স হচ্ছে ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। বিশাল জনগোষ্ঠী ‘ফেসবুকের সঙ্গে সম্পৃক্ত’ হয়ে সামাজিক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। শহরের ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে তরুণ প্রজন্ম এখন মোবাইল ফোনে ডুবে থাকে। গ্রামের তরুণ প্রজন্মের সন্ধ্যায়, অন্ধকার পরিবেশে একটি নির্জন স্থানে জটলা হয়ে বসে মোবাইলে গেম খেলার পাশাপাশি ফেসবুক, ইউটিউব কুরুচিপূর্ণ ভিডিও দেখে। তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেটের অপব্যবহার করে ‘চিন্তা–চেতনার অবক্ষয়’ নিজ থেকেই সৃষ্টি করছে।
ইউটিউব ও গুগলে আপত্তিকর ভিডিওতে আসক্ত হয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে শিক্ষার্থী। লেখাপড়ার মারাত্মক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এমন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারেই হারিয়ে ফেলছে সৃজনশীলতা এবং বাড়ছে উগ্রতা।
মানুষদের মাঝে বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য ছড়িয়ে দিলেও নির্মাতাদের পরিবারে প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহারে আছে বিধিনিষেধ। তাদের উঠতি বয়সের সন্তানেরা কোনোভাবেই যেন প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসতে না পারে। সেই বিষয়ও নিশ্চিত করে তারা। স্টিভ জবস বলেন, তাঁর সন্তানদের জন্য আইপ্যাড ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ বলেছেন, তিনি নিজে অনুভব করেন এই ফেসবুক হলো ‘ভয়ংকর ভুল’।
আর অনৈতিক অবক্ষয় থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন শিক্ষার্থীরা। কোমলমতি বহু ছেলেমেয়ের আচার–আচরণের পরিবর্তনও হচ্ছে। ‘হাতে মোবাইল পেয়ে’ তারা ঠিকমতো বাসায় থাকতে চায় না। লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতেই চায় না। পড়ার টেবিলে, ঘুমের ঘরে এমনকি খেতে বসেও ফোন চালাতে দেখা যায় এদের।
ছেলেমেয়েরা তাদের মোবাইল ফোনে গেমের পাশাপাশি ইন্টারনেটেও অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে। এ কারণে তাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটছে। আসক্তিতে তাদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং মা–বাবার উচিত ঘরে-বাইরে তারা কী করছে, নজরদারিতে রাখা। লেখাপড়া শেষ করে রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়ত যারা, তারা রাত ১২টা বা ১টায়ও ঘুমাতে যায় না।
গবেষণায় জানা গেছে, ঘুমের আগে মোবাইলের ‘ডিসপ্লের আলোকরশ্মি’ ঘুমের হরমোনকে অনেক বাধা সৃষ্টি করে থাকে। মা–বাবাদের প্রতি গবেষকদের পরামর্শ হলো, ঘুমের আগে যদি সন্তানকে এই ধরনের প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসতে দেওয়া হয়, তাহলে খুব ক্ষতি হবে। ঘুম না হলে অসুস্থভাবে বেড়ে ওঠা তরুণ–তরুণীদের বহু ক্ষতি হয়। পরিপূর্ণ ঘুম না হলে ‘স্মৃতিশক্তির স্বাভাবিকতা’ নষ্ট হয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বিটিআরসির কোনো সক্ষমতা নেই। তবে সরকার বা বিটিআরসি ‘ফেসবুককে অনুরোধ’ করতে পারে। ফেসবুক ব্যবসা করতে এসেছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলেন, ১৮ বছরের নিচের ছেলেমেয়েরা তাদের গ্রাহক। আবার ৬৫ বছরের মানুষও গ্রাহক। ফেসবুক কিন্তু সব অভিযোগ বিবেচনায় নিতে বাধ্য নয়। ফলে প্রযুক্তিতে ভালোর চেয়ে দিনে দিনে খারাপের দিকেই যেন ঝুঁকে পড়ছে তরুণ প্রজন্ম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেন অতিমাত্রায় বিচরণের ফলে মাদকাসক্তির মতো খারাপ ফলাফল প্রকাশ পাচ্ছে।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৮ বছরের নিচে ‘ফেসবুক আইডি’ খুলতে পারবে না। কিন্তু ছেলেমেয়েরা মা–বাবা ও আত্মীয়স্বজনদের ভোটার আইডি দিয়ে ‘মোবাইল সিম’ কিনে নিজ বয়স বাড়িয়ে ফেসবুক আইডিও খুলে ফেলছে। ‘১৮ বছর’ বয়সের নিচে ৬৫ ভাগ ছেলেমেয়ে ফেসবুক ব্যবহার করছে। ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসব ‘মুঠোফোন বা ইলেকট্রনিক’ যন্ত্রের মতো বহু বদভ্যাসকেই চিহ্নিত করে তাকে পরিহার করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার চাইলে ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় ব্রাউজার তৈরি করে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিটিআরসি ইচ্ছা করলে ফেসবুকের ওপর বয়স ভেরিফিকেশন করতে পারে। বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ‘চীনের মতো ব্রাউজার’ তৈরি করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলেই মনে করছেন আইসিটি বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে আমাদের দেশে তেমন কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেই।
ভারত ‘তথ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা’ নিশ্চিতকরণেই সরকারি অফিসে বসে ‘কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনে’ ফেসবুক, টুইটার ও হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পাশাপাশি তারা গুগল ড্রাইভ ও ইউএসবি ড্রাইভ ব্যবহারও সীমিত করা হয়েছে। ভারতজুড়েই সাইবার অপরাধ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতেই যেন তাদের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাই বাংলাদেশের সরকার চাইলে ভারতের মতো এ দেশেও আইন করে সমাজ রক্ষায় ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ