ফেসবুক-ইউটিউব নিয়ন্ত্রণে ভারতের পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ

প্রয়োজনে ফেসবুকসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে কনটেন্ট সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা চায় বিটিআরসি
 ছবি: রয়টার্স

‘ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম’ নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন একটি প্রবিধানের খসড়া পেশ করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। ৩ ফেব্রুয়ারি কমিশনের ওয়েবসাইটে সে খসড়া প্রকাশ করে পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ আহ্বান করা হয়। মতামত প্রদানের সময় শেষ হয়েছে গত শুক্রবার।

প্রস্তাবিত প্রবিধানটির উদ্দেশ্য মূলত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টের ওপর সরকারি সংস্থার নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করা। জরুরি প্রয়োজনে কোনো কনটেন্ট সরানোর জন্য যেন ফেসবুক-ইউটিউবের মতো সেবাগুলোর মালিকপক্ষের অপেক্ষায় না থাকতে হয়, তা নিশ্চিত করা। এর সঙ্গে আরও অনেক দিক উঠে এসেছে। প্রবিধানের মূল বিষয়গুলো আপনারা এখান থেকে দেখে নিতে পারেন

এ লেখা মূলত খসড়ার ‘৭.০৩’ নম্বর অংশ নিয়ে। উল্লেখিত অংশে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ও মেসেঞ্জারের মতো বার্তা আদানপ্রদানের সেবার ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে। বলা হয়েছে, আদালত কিংবা বিটিআরসি নির্দেশ দিলে কোনো বার্তার প্রথম প্রেরকের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে।

ব্যাপারটা এমন—মনে করুন, কেউ একজন অনেক সদস্যের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে মিথ্যা তথ্য শেয়ার করেছেন। এরপর সেই তথ্য একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে—এভাবে বড় একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিঘ্ন হলো। এখন বিটিআরসি নির্দেশ দিলে মিথ্যা তথ্যের বার্তাটি প্রথম যিনি শেয়ার করেছেন, তাঁর পরিচয় প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছে উপস্থাপিত খসড়ায়। সেই ব্যক্তি যদি দেশের বাইরে থাকেন, তবে দেশের ভেতরে যিনি বার্তাটি প্রথম শেয়ার করেছেন, তাঁকে চিহ্নিত করে দিতে হবে।

ভারতে কার্যকর আইটি রুলস ২০২১-এর বার্তা আদানপ্রদান সেবাগুলোর জন্য নির্দেশনা। ছবি: ভারতের ইলেকট্রনিকস ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট

গত বছর ঠিক এমনই একটি প্রবিধান যুক্ত হয় ভারতের ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায়। লম্বাচওড়া নাম থালেও সেটি ‘আইটি রুলস, ২০২১’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ইলেকট্রনিকস ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সেটি প্রণয়ন করা হয়।

২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রবিধানটি প্রকাশ করে বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয় সে অনুযায়ী কাজ করতে। সে প্রবিধানেও বিটিআরসির মতোই বলা হয়েছিল, আদালত কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে কনটেন্ট ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে নিতে হবে। আর সে কাজ সমন্বয় ও অভিযোগ গ্রহণের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পদে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মী নিয়োগ দিতে বলা হয়। এই কর্মীরা অবস্থান করবেন ভারতে।

সেখানে বার্তা আদানপ্রদানের সেবা বা মেসেজিং প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যাপারে হুবহু নির্দেশনা রয়েছে—আদালতের নির্দেশে কোনো বার্তার প্রথম প্রেরককে চিহ্নিত করে দিতে হবে।

বিটিআরসির প্রবিধানের খসড়ায় বার্তা আদানপ্রদান সেবাগুলোর জন্য নির্দেশনা। ছবি: বিটিআরসির ওয়েবসাইট

আপাতদৃষ্টে বিটিআরসির খসড়া প্রবিধানটির অনেকাংশ ভারতের আইটি রুলস, ২০২১ থেকে সরাসরি নেওয়া বলে মনে হচ্ছে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিটিআরসির আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই রাকিব নিজেই বলেছেন, খসড়াটি তৈরির সময় ভারত, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের নীতিমালাগুলো দেখা হয়েছে।

যা হোক, নতুন আইটি রুলস প্রচলনের পর সেটিকে ‘অসাংবিধানিক’ উল্লেখ করে গত বছরে মে মাসে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দেয় হোয়াটসঅ্যাপ। মেটা প্ল্যাটফর্মসের মালিকানাধীন বার্তা আদানপ্রদানের সেবাটির বক্তব্য ছিল, কোনো ভাইরাল বার্তার প্রথম প্রেরককে চিহ্নিত করে দিতে হলে ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’ ভাঙতে হবে, যা ব্যবহারকারীর তথ্যের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

হোয়াটসঅ্যাপের দাবি অনুযায়ী, অ্যাপটির মাধ্যমে পাঠানো যেকোনো বার্তা কেবল প্রেরক আর প্রাপক ছাড়া কেউ দেখতে পান না। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষও নয়। সে জন্যই এটাকে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড বলা হয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোনো বার্তার উৎস শনাক্ত করতে হলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো সব বার্তার এনক্রিপশন অকার্যকর হয়ে পড়বে। এতে ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে।

সে সময় আরেকটি প্রশ্ন রাখে হোয়াটসঅ্যাপ। ভারত সরকার চাইলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সরকার তো উৎস সন্ধান বা ট্রেসেবিলিটি চালু করতে দেবে না। সে ক্ষেত্রে ইউরোপের কেউ কীভাবে নির্বিঘ্নে হোয়াটসঅ্যাপে তার ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথন চালাবে? এক পক্ষের এনক্রিপশন আছে, অপর পক্ষের নেই, তা তো আর হতে পারে না।

ভারতীয় সরকার অবশ্য বলেছে, এনক্রিপশন না ভেঙেও ট্রেসেবিলিটি চালু করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে হয়তো নতুন প্রযুক্তি চালু করতে হতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আর নতুন নিয়ম সাধারণ ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার স্বার্থেই। এর পাশাপাশি জনসাধারণের সচরাচর জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া হয়েছে। তবে সেসব উত্তরে সবাই নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। অনলাইনে বাক্‌স্বাধীনতা খর্বের আশঙ্কায় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সাধারণ জনগণও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।