শরীয়তপুরের জাজিরা-শিমুলিয়া নৌপথের সাত্তার মাদবর, মঙ্গল মাঝির ঘাটে পণ্যবাহী যান পারাপারে বাড়তি টাকা গুনতে হয় চালকদের
শরীয়তপুরের জাজিরা-শিমুলিয়া নৌপথের সাত্তার মাদবর, মঙ্গল মাঝির ঘাটে পণ্যবাহী যান পারাপারে বাড়তি টাকা গুনতে হয় চালকদের

ফেরির সিরিয়াল দ্রুত পেতে দিতে হয় টাকা

আগেভাগে ফেরি পারাপার হতে শরীয়তপুরের জাজিরা-শিমুলিয়া নৌপথের সাত্তার মাদবর, মঙ্গল মাঝির ঘাটে পণ্যবাহী ট্রাকের চালকদের অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে। ওই পথে রাতে চলাচলকারী পণ্যবাহী গাড়ি থেকে স্থানীয় একটি চক্র টাকা তুলছে। ট্রাফিক পুলিশের সামনে টাকা তোলা হলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জরুরি কাঁচামালবাহী গাড়ির চালকদের অভিযোগ, রাতে ঘাটে আসা গাড়িগুলোকে দ্রুত ফেরির সিরিয়াল পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে স্থানীয় শহীদ চেংগা নামের এক ব্যক্তি ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা নেন। টাকা নেওয়ার পর তিনি যে গাড়িগুলোকে সামনের দিকে পাঠান ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা সেই গাড়িগুলোকে ফেরিতে ওঠার সুযোগ করে দেন। এ বিষয়ে কোনো চালক প্রতিবাদ করলেই তাঁকে মারধর করা হয়।
টাকা ওঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঘাটে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। থানা–পুলিশকে জানানো হয়েছে।’

ট্রাফিক পুলিশের সামনেই এমন ঘটনা ঘটছে এবং টাকা নেওয়ার পর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা ওই গাড়ি ফেরিতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফুর রহমান বলেন, ফেরিঘাটে ট্রাফিক পুলিশের ১০ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে একজন টাউন ইন্সপেক্টর, চারজন সার্জেন্ট ও চারজন কনস্টেবল আছেন। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারেন।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) ও স্থানীয় সূত্র জানায়, মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথ দিয়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী যানবাহন ফেরিতে পারাপার করে। ওই নৌপথে ফেরি চলতে গিয়ে গত বছরের ২০ জুলাই পদ্মা সেতুর একটি পিলারের সঙ্গে রো রো ফেরির ধাক্কা লাগে। নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় ফেরিগুলো পদ্মা সেতুর সঙ্গে কয়েক দফা ধাক্কা লাগে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ১৮ আগস্ট থেকে ওই নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন থেকে শরীয়তপুরসহ দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের চলাচলের জন্য ও জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার সাত্তার মাদবর-মঙ্গল মাঝির ঘাট এলাকায় নতুন একটি ফেরিঘাট নির্মাণ করা হয়। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে ওই নৌপথে ফেরি চলাচল শুরু হয়।

শরীয়তপুরের জাজিরা-শিমুলিয়া নৌপথের সাত্তার মাদবর, মঙ্গল মাঝির ঘাট

বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নৌপথটিতে দিনে তিনটি এ-টাইপের ফেরি, দুটি ডাম্প ফেরি ও একটি ছোট ফেরি চলাচল করছে। আর রাতে শুধু তিনটি এ-টাইপের ফেরি চলাচল করছে। তখন ডাম্প ফেরি দুটি ও ছোট ফেরি বন্ধ রাখা হয়। দিন–রাতে মিলে নৌপথটিতে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাতে এ ঘাট দিয়ে ২০০-২৫০টি পণ্যবাহী ট্রাক পার করা হচ্ছে। সামনে ঈদ হওয়ার কারণে ঘাটটিতে পণ্যবাহী ও ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সন্ধ্যার পর কাঁচামালবাহী ট্রাক ঢাকা যাওয়ার জন্য সাত্তার মাদবর, মঙ্গল মাঝির ঘাটে আসা শুরু করে। নৌপথটিতে ফেরি কম থাকায় ঘাটে গাড়ির জটলা লাগে। তখন সড়কে দীর্ঘ সারিতে পারাপারের জন্য গাড়িচালকদের অপেক্ষা করতে হয়।
এই সুযোগে শহীদ চেংগার নেতৃত্বে একটি চক্র পণ্যবাহী গাড়ি ফেরিতে আগে তুলে দেওয়ার কথা বলে গাড়িপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা তোলে। টাকা দেওয়ার পর রং সাইড দিয়ে ওই গাড়িগুলো ফেরিঘাটের দিকে আনা হয়। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা গাড়িগুলো ফেরিতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তখন ব্যক্তিগত গাড়ি দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়। কেউ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ও প্রতিবাদ করলে তাঁদের মারধর করা হয়।

গত শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাত্তার মাতবর, মঙ্গল মাঝির ঘাটে আসা পণ্যবাহী ট্রাক থেকে টাকা তুলছিলেন শহীদ চেংগা। এ সময় গাড়ির লাইন থেকে সিরিয়াল ভেঙে ফেরিঘাটের দিকে গাড়ি পাঠানোর প্রতিবাদ করেন চালক নান্নু মিয়। প্রতিবাদ করায় ওই চালককে মারধর করেন শহীদ ও তাঁর লোকজন।

নান্নু মিয়া বলেন, ‘আমরা গাড়ি নিয়ে ফেরিতে ওঠার জন্য সিরিয়ালে অপেক্ষা করছিলাম। শহীদ টাকা নিয়ে সিরিয়াল ভেঙে গাড়ি ছাড়ছিলেন। আমি এর প্রতিবাদ করি। তখন চার-পাঁচজন মিলে আমাকে মরধর করে।’

অভিযোগ অস্বীকার করে শহীদ চেংগা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোন গাড়ি থেকে টাকা তুলছি না। আমাদের সড়কটি সরু। অনেক সময় দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে গিয়ে যানজট লেগে যায়। তখন অনেককে সহায়তা করি। বিনিময়ে কারও কাছ থেকে টাকা নেই না।’

গোপালগঞ্জ থেকে মুরগি নিয়ে শনিবার রাতে ঢাকা যাচ্ছিলেন এক চালক। তিনি সাত্তার মাদবর, মঙ্গল মাঝির ফেরিঘাট থেকে এক কিলোমিটার দূরে অপেক্ষা করছিলেন। আগে ফেরির সিরিয়াল পাওয়ার জন্য ওই চালক শহীদ চেংগাকে এক হাজার টাকা দেন। এরপর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা তাঁকে ফেরিতে ওঠার সুযোগ করে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই চালক বলেন, ‘রাতে ফেরিঘাটে গাড়ির চাপ থাকে। আমরা অনেকেই বাজার ধরার জন্য আগে যাওয়ার চেষ্টা করি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে শহীদের মাধ্যমে পুলিশ টাকা নেয়। প্রতি রাতে এভাবেই এ ঘাট দিয়ে আমরা যাতায়াত করছি।’

জানতে চাইলে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার এস এম আশ্রাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘাটে কেউ চাঁদাবাজি করে, এমন তথ্য আমার কাছে নেই। ঘাটগুলোতে স্থানীয় সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে, তারা অনেক অপরাধ সংঘটিত করে। এমন কোনো চক্র চালক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর ওই ঘটনার সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’