ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার ২০১৯ প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, ফারাজ আইয়াজ হোসেনের আত্মত্যাগ ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা জোগায়। তাঁর আত্মত্যাগ বাংলাদেশে তরুণদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে।
আজ রোববার রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে এক অনুষ্ঠানে ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার ২০১৯ দেওয়া হয়। এবার পুরস্কার পেয়েছেন নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফরিদা ইয়াসমিন। বর্তমানে সরকারের এই কর্মকর্তা ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। বারহাট্টায় কর্মরত থাকার সময় বাল্যবিবাহ ঠেকানোর স্বীকৃতি হিসেবে ফরিদা ইয়াসমিন এ পুরস্কার পেলেন। সেখানে তিনি ৫৯টি বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার ২০১৯–এর জুরিবোর্ড সদস্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, তিনি ফারাজের মধ্যে উচ্চতর সচেতন সাহস দেখতে পেয়েছেন। ফারাজ সামনাসামনি সংঘাতে জড়িয়ে জীবন দেননি। ফারাজ জীবন দিয়েছেন নৈতিকতার জন্য, একটি মূল্যবোধের জন্য, একটি উচ্চতর স্বপ্নের জন্য। একটি বড় পৃথিবীর জন্য, ভালোবাসার বন্ধুত্বের জন্য, মানবিকতার জন্য।
এবারের পুরস্কারজয়ী ফরিদা ইয়াসমিন সম্পর্কে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, বাল্যবিবাহ খারাপ। কিন্তু এটা তাঁর চাকরির অংশ নয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ তিনি নিজ মূল্যবোধ থেকে করেন।
পেপসিকোর ইন্ডিয়া রিজিয়নের প্রধান আহমেদ আল শেখ বলেন, ‘ফারাজের আত্মত্যাগ সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করেছিল। তাঁর সাহসী কাজটি মানবজাতির জন্য আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। ফারাজের এই সাহসের গল্প সব সময় বলে যেতে হবে। এমন আত্মত্যাগ শুধু আশা দেখায় বা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায় না, ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা জোগায়। তিনি আরও বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য আরও গৌরবের যে সে ট্রান্সকম পরিবারের একজন। আমি নিজেও ফারাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ফারাজের আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করবে—যা শুধু বাংলদেশেই নয়, সারা বিশ্বেও।’
ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের পক্ষে তাঁর মেয়ে ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন পেপসিকোসহ সবাইকে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এ পুরস্কার ভবিষ্যতের নেতৃত্বকে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ফারাজ সম্পর্কে বলেন, তাঁর স্মৃতিতে ফারাজ ছোট্ট স্নেহের পুত্র, একজন ভাই, একজন নাতি, একজন ভালো বন্ধু। ফারাজ সবার মাঝে বেঁচে আছে, তা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ফারাজের ভাই যারেফ আয়াত হোসেন। তিনি পরিবারের পক্ষ থেকে হোলি আর্টিজান হামলা মামলার রায়ে সরকারের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। যারেফ বলেন, সেই রাতে ফারাজ যা করেছে, তা বাংলাদেশের তরুণদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। বিশ্বকে গড়ে তুলতে যুবসমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এই তরুণেরাই ভবিষ্যৎ তৈরি করবে। ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কাজের কথা তুলে ধরে যারেফ বলেন, মানুষ হিসেবে ফারাজ সবাইকে এক করেছে।
২০১৭ সালের মে মাসে বারহাট্টা উপজেলায় ইউএনও পদে যোগ দিয়েছিলেন এবারের পুরস্কারপ্রাপ্ত ফরিদা ইয়াসমিন। বারহাট্টা উপজেলায় বাল্যবিবাহের কোনো খবর পেলেই তা বন্ধের জন্য ছুটে যেতেন তিনি। রাত-দিন কিংবা ঝড়-বৃষ্টি কিছুই তাঁর পথ আগলে রাখতে পারত না। সেখানে তিনি ৫৯টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। এর মধ্যে চারজন ছিল অসচ্ছল পরিবারের সদস্য। তারা নিরুপায় হয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিল। ফরিদা ইয়াসমিন নিজের খরচে ওই চার মেয়ের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
পুরস্কার গ্রহণের পর ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘এই পুরস্কার আমার জন্য অনুপ্রেরণা। ফারাজের আত্মত্যাগের কাছে আমার এ কাজ কিছুই নয়। ফারাজের আত্মত্যাগ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমি আমৃত্যু বাংলাদেশের নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করে যাব।’ তিনি বলেন, ফারাজের আত্মত্যাগ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক।
দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত বিচারকমণ্ডলী ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কারের জন্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছেন। আট সদস্যের জুরিবোর্ডের চেয়ারম্যান হচ্ছেন বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। সদস্যরা হলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, এমসিসিআইয়ের সভাপতি নিহাদ কবির, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক সাবাহাত জাহান, পেপসিকো বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার দেবাশীষ দেব এবং ফারাজের নানা ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান।
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারাজ আইয়াজ হোসেন। পুরস্কার ঘোষণায় পেপসিকো গ্লোবাল বলেছে, ফারাজ প্রকৃত বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বন্ধুদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। দৃঢ়তার সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশি তরুণ বা তরুণীদের মধ্যে সাহসিকতার স্পৃহাকে উদ্দীপ্ত করতে এবং ফারাজের চেতনা জাগিয়ে তোলাই এই পুরস্কারের লক্ষ্য।
এর আগে ২০১৬ সালে প্রথম ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার পেয়েছিলেন মাদারীপুর কলেজের কর্মচারী মিরাজ সরদার। ওই কলেজের শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলাকারী জঙ্গিকে তিনি হাতেনাতে ধরে ফেলেন। ২০১৭ সালে পুরস্কার পান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খন্দকার আবু তালহা। এক প্রতিবেশী ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন দেখে তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ দিয়েছিলেন তালহা।
অনুষ্ঠানে ফারাজ হোসেনকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সব শেষে একটি গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
আরও পড়ুন: