ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। শেষ মুহূর্তে ‘অস্বাভাবিক’ আচরণের কারণে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা হয়। পরে ফাঁসির আদেশ মওকুফ করে তাঁর সাজা ১৪ বছরের কারাদণ্ডে নামিয়ে আনা হয়। এবার ‘ভালো’ আচরণের কারণে ১৪ বছরের কারাদণ্ডে এক বছর এক মাস ১৩ দিন রেয়াতও পেলেন। সাজা কমে যাওয়ায় আগামী মে-জুন মাসে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন হত্যা মামলার আসামি যুবলীগের নেতা আসলাম ফকির।
আসলাম ফকির বর্তমানে ফরিদপুর কারাগারে রয়েছেন। তাঁর মুক্তির প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে তাঁকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে আনা হয়েছে।
আসলাম ফকিরের মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফরিদপুর জেলা কারাগারের সুপার আবদুর রহিম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আসলাম ফকিরের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন অর্থাৎ ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিভিন্ন কারণে রেয়াত পাওয়ায় আগামী মে বা জুনের মধ্যে তিনি মুক্তি পেতে পারেন।
২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মানিকদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেব আলী ওরফে সাহেব মিয়াকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হন আসলাম ফকির। এদিকে আসলাম ফকির মুক্তি পেতে যাচ্ছেন জেনে হত্যা মামলার বাদী সাহেব মিয়ার স্ত্রী পারুলী বেগম তিন সন্তান ও নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
কারাগার সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ মে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন আসলাম ফকির। ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর তা নামঞ্জুর হয়। ফলে ওই বছরের ১৩ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ধার্য করা হয়। এ বিষয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য চিঠি পাঠানো হয়। ফাঁসি কার্যকরের এক দিন আগে ১২ নভেম্বর বন্দী আসলাম ফকির এমন আচরণ শুরু করেন, যা কারাগারের নথির ভাষায় ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘অসুস্থতা’। এতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকরণ স্থগিত করা হয় এবং ওই দিনই দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়।
দ্বিতীয় দফায় প্রাণভিক্ষার আবেদন গৃহীত হয়ে আসলামের দণ্ড কমিয়ে আনা হয়।
জেলা কারাগার সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২৮ আগস্ট থেকে আসলাম ফকিরের কারাভোগ শুরু হয়। ফাঁসির দণ্ড মওকুফ করে তাঁকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ায় তাঁর ১৪ বছর সাজা খাটার কথা ছিল। তবে কারাগারে ভালো আচরণ ও কাজের জন্য তিনি রেয়াত পাচ্ছেন। তিনি এ খাতে ১ বছর ১ মাস ১৩ দিন রেয়াত পাচ্ছেন।
২০০৩ সালের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে মানিকদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এ কে এম সাহেব আলী ওরফে সাহেব মিয়া। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২৯ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান আসলাম ফকির। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ইউপি চেয়ারম্যান সাহেব আলীকে হত্যা করা হয়। পরদিন সাহেব আলীর স্ত্রী পারুলী বেগম বাদী হয়ে আসলাম ফকিরের নাম উল্লেখ করে ভাঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
মামলার বাদী পারুলী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত আসলাম ফকিরকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আমাদের জানামতে, প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর ফাঁসি কার্যকরের তারিখও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কী কারণে এ দণ্ড মওকুফ করা হয়, তা আমার বোধগম্য নয়।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘বিশ্বের কোন আইনে আছে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার পর দণ্ড মওকুফ হয়?’ তিনি বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি খুব দ্রুত মুক্তি পাবে আসলাম ফকির। এ অবস্থায় আমি নিজের, দুই ছেলে ও এক মেয়ের জীবন নিয়ে শঙ্কা বোধ করছি।’
যুবলীগের নেতা আসলাম ফকিরকে ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রেহাই দেওয়া, এমনকি কারাগার থেকে মুক্ত করতে কর্তৃপক্ষের বিশেষ তৎপরতা দেখা গেছে। তাঁর সাজা মওকুফের আবেদন করা হয়েছে দুবার। প্রথমবার সেটা নাকচ হয়েছিল, দ্বিতীয়বার গৃহীত হয়। এ ছাড়া বিশেষ দিবসে বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে গত বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্যও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাংসদ নিলুফার জাফরউল্লাহ। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, আসলাম ফকিরকে ষড়যন্ত্রমূলক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আসলামের বয়স এখন ৫০ বছর। তিনি নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। তাই তাঁর অবশিষ্ট সাজা মওকুফ করে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হোক। তবে সাংসদের এই অনুরোধ কাজে দেয়নি।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের শুকুর ফকিরের ছেলে আসলাম ফকির ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ আলী ওরফে সাহেব আলী মিয়াকে হত্যা করেন। দুজনেই ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে আসছিলেন পালাক্রমে। সর্বশেষ নির্বাচনে পরাজয়ের ক্ষোভ ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে আসলাম এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
পুলিশ তদন্ত শেষে আসলাম ফকির ও তাঁর দুই সহযোগী তারা মৃধা ও ইমারত আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। জেলা ও দায়রা জজ আদালত তিন আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পরে হাইকোর্ট এ রায় বহাল রাখেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিম কোর্ট আসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তারা মৃধা ও ইমারত আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
এ ব্যাপারে আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, দুনিয়ার সব দেশেই খুনের আসামির সাজা মওকুফ করতে ভুক্তভোগী পরিবারের মতামত নেওয়া হয়। তাদের যদি অভিযোগ না থাকে, তবেই হয়তো সরকার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।