ফাঁসি কার্যকরের আগে সতর্ক সরকার

রাজনৈতিক চাপ সামলে উঠলেও দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকরের আগেভাগে দেশজুড়ে অন্য রকম পরিস্থিতি ও চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। কখন, কী ঘটে—সেই আশঙ্কায় সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি ও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্যারিসে হামলার পর ইউরোপের পরিস্থিতি এবং দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের দুটি ও মাল্টা সফর বাতিল করেছেন। চাঞ্চল্যকর হামলা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নাশকতার আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই আশঙ্কা থেকেই সব বিমানবন্দরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একইভাবে কারাগারগুলোতেও নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বেড়েছে নিরাপত্তা তল্লাশি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, একের পর এক রোমহর্ষক ঘটনায় সরকারের ভেতরে-বাইরে অস্থিরতা যেমন আছে, তেমনি আছে এর চেয়ে বড় কিছু ঘটতে পারে—এমন ভীতিও। কিন্তু দুর্বৃত্তদের ঠেকানো যে সম্ভব হচ্ছে না, তার প্রমাণ গত প্রায় দুই মাসের রোমহর্ষক ও নৃশংস সব ঘটনা।
তবে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত দেশটাকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা যে এখন করছে, তা নয়। ২০০৯ সাল থেকেই তাদের ইন্ধনে নাশকতার ঘটনা ঘটছে। এ জন্য সরকারও সতর্ক। তবে এটাও সত্য যে, দেশে এখন ওই অর্থে সংকট নেই। অর্থনীতির সব সূচকে অগ্রগতি রয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। কিন্তু সরকারও বসে নেই, দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার চলছে।
সরকারের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও তাঁরা মনে করছেন, পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সরকার অতিমাত্রায় সতর্ক। এর প্রভাব জনমনে পড়লেও তা শিগগিরই কেটে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও চোরাগোপ্তা হামলা ঠেকাতে পারে না। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বরং সেই তুলনায় ভালো। তিনি গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমাদের পায়ে কাঁটা ফুটেছে। এটা বের করার চেষ্টা চলছে। এ জন্য রক্তক্ষরণ হলেও সেই বেদনা সইতে হবে।’
একাধিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছেন, আগুন-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের তিন মাস সময় লেগেছে। এখনকার এই পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে, তবে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা জানুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকবে বলে মনে করছেন। ওই সময়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে বিরোধী দলও সরকারকে চাপে ফেলার নানা চেষ্টা করবে বলে তাঁরা মনে করছেন।
তবে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা মাঝেমধ্যে থমকে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক বাড়ছে। অস্ত্র কাছে থাকলেও দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষায় পুলিশের সাম্প্রতিক দুটি ব্যর্থতা সরকারকে চিন্তায় ফেলে দেয়।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, যাতে দেশকে অস্থিতিশীল ও জনমনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করা সহজ হয়। এর মাধ্যমে দেশে-বিদেশে এমন বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না।
কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও গত মঙ্গলবার দিনাজপুর শহরে এক ইতালীয় নাগরিক ও পেশায় চিকিৎসক পিয়েরো পিচমকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা হয়। তার আগে গত রোববার ঢাকা সেনানিবাসের প্রবেশপথ কচুক্ষেতে মিলিটারি পুলিশের এক সদস্যকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনাও বিশেষ বার্তা বলে মনে করা হচ্ছে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলে আসছেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় যত এগিয়ে আসছে, ততই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা চলছে। পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটতে পারে, সে বিষয়টিও আন্দাজ করতে পারছেন না অনেকে।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাংশের ধারণা, এখনকার পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দেশের ভেতরকার একটি চক্রের সঙ্গে দেশের বাইরের একটি শক্তির যোগসূত্র রয়েছে। এই দুটি শক্তির লক্ষ্য—দুই যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ঠেকানোর চেষ্টা। একই সঙ্গে দেশকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। এখন থেকে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলেও তাঁরা মনে করছেন। তাঁদের মতে, যে বা যারাই করুক দুই বিদেশিকে হত্যা, আরেক বিদেশিকে হত্যাচেষ্টার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা এবং বিদেশিরাও যে নিরাপদ নন, এটা প্রমাণের চেষ্টা করা।
সরকারের উচ্চপর্যায় এবং বিভিন্ন সংস্থা সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জামায়াত-শিবিরকে দায়ী বলে অভিযোগ করছে। এ ক্ষেত্রে সরকার মনে করে, জামায়াত-শিবির বিএনপিরও সহায়তা পাচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ডে কারা জড়িত, সে বিষয়ে সরকার এখন পর্যন্ত অন্ধকারে রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াত তাদের অংশগ্রহণ বা সমর্থনের কথা বরাবর অস্বীকার করে আসছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এভাবে প্রতিটি ঘটনাই নষ্ট করছে। বিরোধীদের ওপর অন্ধভাবে দায় চাপানোর প্রবণতার কারণে প্রকৃত আসামিরা ছাড় পাচ্ছে।