>কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সারাতে প্লাজমা থেরাপির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সরকারের করা কারিগরি উপকমিটির প্রধান অধ্যাপক এম এ খান। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হেমাটোলজি ও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগের নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
প্রথম আলো: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার চিন্তাটা কীভাবে এল?
এম এ খান: গত ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) যখন কনভেলিসেন্ট প্লাজমা ব্যবহারের জন্য গবেষণামূলক নতুন ওষুধ (আইএনডি) হিসেবে অনুমতি দিল, তখনই আমি এই নিয়ে চিন্তা করি। এই সহজ পদ্ধতি আমরা সহজে ব্যবহার করে উপকার পেতে পারি। কারণ, এই কোভিড-১৯–এর চিকিৎসার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ বা টিকা নেই। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। এ মৃত্যুটি আমার মনে বিশেষভাবে দাগ কাটে। এরপরই প্লাজমার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের চিন্তাটা করি।
প্রথম আলো: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দিয়ে সাফল্য কোথায় এসেছে?
এম এ খান: সর্বপ্রথম ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের হুনান শহরে ৫ জন রোগীর ওপর এবং পরবর্তী সময়ে ১০ জন এবং এরও পরে ২৪৫ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ওপর ব্যবহার করে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গিয়েছিল। এসব আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমেরিকায় এ পর্যন্ত ১৫ হাজারের অধিক রোগীকে কনভেলিসেন্ট প্লাজমা দেওয়া হয়েছে এবং এর চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
প্রথম আলো: ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীর অ্যান্টিবডি আদৌ সুরক্ষা দেবে কি না, সেটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়। বিষয়টি কি আপনারা বিবেচনায় নিয়েছেন?
এম এ খান: বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। ডব্লিউএইচও ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাসের প্লাজমা থেরাপি ব্যবহারের জন্য একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছিল। প্লাজমা থেরাপি নিয়ে বড় ধরনের কোনো গবেষণা না হওয়ায় এর সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকারিতা ও কতখানি নিরাপদ, তা সম্পর্কে ধারণা কম থাকাতে ঢালাওভাবে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তবে ডব্লিউএইচওর ওষুধের তালিকায় এটি রয়েছে।
প্রথম আলো: প্লাজমা থেরাপিতে আসলে কী করা হয়?
এম এ খান: রক্তের জলীয় অংশকে প্লাজমা বলে। কোনো ব্যক্তি ভাইরাস–ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলে ৫ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে তার শরীরে জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হয়। ফলে তার রক্তে একধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এবং ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় ও এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির রক্তের প্লাজমাতে এই অ্যান্টিবডি রয়েছে, যা সংগ্রহ করে কোভিড আক্রান্ত রোগীর শরীরে দিলে সাময়িক প্যাসিভ ইমিউনিটি তৈরি হয়। এই অ্যান্টিবডি সার্চ করোনা-২ ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে এবং রোগী সুস্থ হতে থাকে হয়।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি দেওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু?
এম এ খান: এপ্রিল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিশ্বের ৬০টি দেশে প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করা হচ্ছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে এই প্লাজমা থেরাপির বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, আমাদের আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের সংখ্যা সীমিত। উপরন্তু কোনো ওষুধ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। এই প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করে আমরা আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের ওপর চাপ কমাতে পারব বলে মনে করি।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপিতে রোগী সারানোর ক্ষেত্রে আগের রেকর্ড কেমন? অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে?
এম এ খান: প্লাজমা থেরাপি এর আগে বাংলাদেশে ব্যবহার হয়েছে বলে আমার জানা নেই, এবারই প্রথম। তবে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যায় আমরা ফ্রেশ প্লাজমা (এফএফপি) ব্যবহার করে থাকি।
প্রথম আলো: আপনি যে কমিটির নেতৃত্বে আছেন, সেই কমিটির সক্ষমতা কতটুকু। সক্ষমতা বলতে বোঝাচ্ছি প্লাজমা সংগ্রহ, পরীক্ষার জন্য যেসব যন্ত্রাংশের প্রয়োজন, সেসব পর্যাপ্ত আছে? আর্থিক সক্ষমতা কতখানি?
এম এ খান: এই টেকনিক্যাল উপকমিটিকে প্লাজমার গবেষণা প্রটোকল তৈরির জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে ইতিমধ্যে আমাকে জাতীয় টেকনিক্যাল উপদেষ্টা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ফলে প্লাজমা থেরাপি নিয়ে কিছু পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে প্লাজমা থেরাপির জন্য বাজেট চাওয়া হয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়াও ব্যাপক চাহিদা পূরণ করার জন্য বর্তমান টেকনিক্যাল সাব-কমিটির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোভিড-১৯ ন্যাশনাল এক্সপানডেড অ্যাক্সেস প্রোগ্রাম করার সুপারিশ (প্রস্তাব) করা হয়েছে। এক্সপানডেড অ্যাক্সেস প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্লাজমা দিলে মান নিয়ন্ত্রণ করা ও রোগীর ফলোআপ ডেটা সংরক্ষণ করা যাবে, যা ভবিষ্যতে গবেষণার কাজে লাগবে, সে সঙ্গে এফডিএর কনভেলিসেন্ট প্লাজমা ব্যবহারের জন্য গবেষণামূলক নতুন ওষুধ (আইএনডি) ব্যবহারের শর্ত পূরণ হবে।
প্রথম আলো: প্লাজমা দেওয়া নিয়ে একটা ভীতি আছে? এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?
এম এ খান: প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের প্রিয়জনকে রক্তদান করছি। এই প্লাজমা দান রক্তদান করার মতোই। ডব্লিউএইচওর নিয়ম মেনে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা বিনা মূল্যে করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়। এতে মাত্র ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট সময় লাগে এবং কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং কোনো ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কাও নেই। সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি পদ্ধতি।
প্রথম আলো: প্লাজমা কীভাবে সংগ্রহ করা হয়, এর পদ্ধতিটি কী?
এম এ খান: কোভিড-১৯ রোগ থেকে সেরে ওঠার ১৪ দিন পর এফেরেসিস মেশিনের সাহায্যে ওই ব্যক্তির শরীর থেকে ৪০০ থেকে ৬০০ মিলিলিটার প্লাজমা সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে রক্তকণিকা (আরবিসি, ডব্লিউবিসি ও প্লেটলেট) প্লাজমাদাতার শরীরে ফিরে যায়। অর্থাৎ, তা সংগৃহীত হয় না, শুধুই প্লাজমাই নেওয়া হয়। একজন প্লাজমাদাতা চাইলে ২৮ দিন পর আবার প্লাজমা দিতে পারবেন। তবে যেসব জায়গায় এই এফেরেসিস মেশিন নেই, সেখানে এক ব্যাগ ব্লাড (হোল ব্লাড) সংগ্রহ করে সেন্ট্রিফিউজ করে প্লাজমা আলাদা করা যেতে পারে এবং তা প্রয়োজনমতো কোভিড রোগীকে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের সম্ভাবনা কতটুকু?
এম এ খান: বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে প্লাজমা থেরাপির প্রয়োজন অনেক বেশি। কারণ, আমাদের হাতে কোনো বিকল্প চিকিৎসা নেই এবং আমাদের আইসিইউ বিছানা ও ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও সীমিত। তবে এই চিকিৎসা ব্যাপকভাবে চালু করার জন্য ন্যাশনাল কোভিড-১৯ এক্সপান্ডেড অ্যাক্সেস প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। তা একটি কমিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এর সঠিক প্রয়োগ এবং পরবর্তী ফলোআপ করতে হবে।