করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থেকে যাঁরা নিজেরাও আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু করেছে সরকার। প্রথম ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে প্রয়াত প্রতিরক্ষাসচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী এবং সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক মো. মঈন উদ্দিনের পরিবার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গতকাল সোমবার উভয় পরিবারের নামে ৫০ লাখ টাকা করে মোট ১ কোটি টাকা মঞ্জুরি দিতে দুটি আলাদা চিঠি পাঠিয়েছে অর্থ বিভাগেরই প্রধান হিসাব কর্মকর্তার কাছে। অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফ স্বাক্ষরিত উভয় চিঠিতে বলা হয়েছে, তাঁদের স্ত্রীদের কাছে ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করবেন অর্থ বিভাগের ড্রইং অ্যান্ড ডিসবার্সিং অফিসার (ডিডিও)।
চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের বাজেটে ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি বাবদ ক্ষতিপূরণের জন্য বিশেষ অনুদান’ খাতে যে ৫০০ কোটি টাবা বরাদ্দ রয়েছে, তা থেকে এ ব্যয় করা হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত রোগীদের সেবায় সরাসরি কর্মরত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্য কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে গত ২৩ এপ্রিল অর্থ বিভাগ যে পরিপত্র জারি করে, সেটি অনুসরণ করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে।
পরিপত্রে বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি চাকরিজীবী যাঁরা নিজেরা আক্রান্ত হবেন বা মারা যাবেন, তাঁদের জন্য গ্রেড অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এর পরিমাণ ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ৫ লাখ টাকা ও মারা গেলে ২৫ লাখ টাকা, ১০ থেকে ১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও মারা গেলে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ১ থেকে নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে ১০ লাখ টাকা এবং মারা গেলে ৫০ লাখ টাকা পাবেন। আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী প্রথম গ্রেড ও মঈন উদ্দিন পঞ্চম গ্রেডের সরকারি কর্মচারী ছিলেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল ক্ষতিপূরণের প্রথম আবেদন করেন মঈন উদ্দীনের স্ত্রী চিকিৎসক চৌধুরী রিফাত জাহান। এর ঠিক ৩ মাস পর গতকাল সোমবার তিনি টাকা পাবেন বলে চিঠি পান।
চৌধুরী রিফাত জাহান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চিঠি পেয়েছেন। তবে টাকা হাতে পেতে আরও কিছু প্রক্রিয়া আছে। সেগুলো শেষ করার অপেক্ষায় আছেন।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান গত ১৫ এপ্রিল। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে চৌধুরী রিফাত জাহানের আবেদনপত্রে সুপারিশ করেন এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ মো.মইনুল হক।
জানা গেছে, গত ৫ এপ্রিল চিকিৎসক মঈন উদ্দীনের করোনা পজিটিভ আসে। অবস্থার অবনতি ঘটলে ৭ এপ্রিল তাঁকে সিলেট নগরীর শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আইসোলেশনে রাখা হয়। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে পরিবারের সিদ্বান্ত অনুযায়ী তাঁকে ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তিনি মারা যান।
এদিকে প্রয়াত সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী মারা যান গত ২৯ জুন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। চিকিৎসা নিচ্ছিলেন বাসায়। পরে তাকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। সেখানে তার করোনা শনাক্ত হয়। দুই সপ্তাহ ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকার পর মারা যান। ক্ষতিপূরণ নেওয়ার চিঠি পাঠানো হয়েছে তাঁর স্ত্রী গুল সাকিনা পারভীনকে।
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৪ হাজার ৪৭২ জন কোভিড ১৯–এ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৬৩ জন।
এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত মিলে সশস্ত্র বাহিনীতে ৬ হাজার ৭৭৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১০৭ জন। তবে মৃতদের মধ্যে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার মতো আছেন ৮জন সৈনিক। অবসরপ্রাপ্ত হয়ে কেউ মারা গেলে পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে না। বাংলাদেশ আনসারের ৯১০ জন সদস্য কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৭ জন। আর ফায়ার ব্রিগেডের ২৪৪জন আক্রান্ত হলেও কেউ মারা যাননি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত ২ হাজার ৩৯২ জন চিকিৎসক কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৬৯ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ ছাড়া ১ হাজার ৬৯৩ জন নার্স এবং চিকিৎসার সঙ্গে সম্পর্কিত আরও ২ হাজার ৭৮৮ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে। নার্স মারা গেছেন ১১জন আর অন্যদের মধ্যে মারা গেছেন ৭ জন।
বিএমএ মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে থেকে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। যতটুকু শুনেছি, মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে আগে। অবশ্যই সবার আগে তাদের পাওয়া উচিত। আবার অনেকে করোনা পজিটিভ দাবি করলেও নিশ্চয়ই অর্থ মন্ত্রণালয় যাচাই–বাছাই করেই টাকা ছাড় করবে।’
জানা গেছে, অর্থ বিভাগ আপাতত মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারকেই ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জেকেজি এবং রিজেন্ট কেলেঙ্কারির পর করোনা পজিটিভ সনদ নিয়ে সন্দিহান থাকায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পান কি না, তা নির্ভর করছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সবুজ সংকেতের ওপর। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা সেই অপেক্ষাতেই রয়েছেন বলে জানা গেছে।