প্রিয় কলেজ সেন্ট যোসেফকে মিস করি

সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল। তাতে কেউ সাফল্য পেয়েছে, কেউ পায়নি। এসএসসির ধাপ শেষে নবীনরা স্বাগত জানাবে তাদের কলেজজীবনকে। ২০১৫ সালের এই সময়টায় আমি ও এসএসসি ধাপ পেরিয়ে সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কলেজজীবন শুরু করি। সময়ের পালাবদলে এই বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আমি। কলেজজীবনের দুই বছরে রয়েছে নানা স্মৃতি। নবীন থেকে প্রাক্তনের খাতায় নাম লেখালেও স্মৃতিগুলো আজ ও অমলিন। কোয়ারেন্টিনের এই সময়টায় নতুনভাবে কলেজের সেই দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণা করলাম।

আমি ২০১৫ সালে মাধ্যমিক পাস করি গাজীপুরের এমইএইচ আরিফ কলেজ থেকে। উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকায় পড়ার ইচ্ছে ছিল। মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর জিপিএ–৫ পাওয়ায় ঢাকায় পড়ার ইচ্ছা আরও বেড়ে গেল। জানতে পারলাম, ঢাকার নটরডেম কলেজ, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণদের ভর্তি করা হবে। আব্বুর সঙ্গে ঢাকায় এসে ঢাকার নটর ডেম কলেজ, সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম তুললাম।

নটর ডেম কলেজের ভর্তি পরীক্ষা প্রথমে ছিল। ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে জ্যামে হলে পৌঁছালাম পরীক্ষা শুরুর ১০ মিনিট আগে। এরপর পরীক্ষা শুরু হলো এবং পরীক্ষা দিয়ে বের হলাম। আশানুরূপ ভালো পরীক্ষা না হওয়ায় একটু মন খারাপ হয়েছিল। পরের দিন ছিল সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা এবং এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সেন্ট যোসেফে পরীক্ষার দিন ছিল প্রথমম রমজান। আগের দিন জ্যামের অভিজ্ঞতার কারণে আগেই বাসা থেকে বের হলাম এবং পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে পৌঁছালাম। সেন্ট যোসেফে ভর্তি পরীক্ষায় লিখিত এবং ভাইবা এই দুই ধাপে ছিল। ভাইভায় আমাকে এক স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি আমি টিকে যাই, তাহলে এখানে পড়ব কি না? আমি উত্তরে বলেছিলাম, জি স্যার পড়ব।

সেন্ট যোসেফে ভর্তি পরীক্ষা ভালোই দিয়েছিলাম। দুদিন পর রেজাল্ট দিল। দেখলাম আমি মেধাতালিকায় দশম স্থান অধিকার করি। খুব আনন্দিত। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় এলাম আব্বুর সঙ্গে, ভর্তি ফরম পূরণ করে সব কাগজপত্র জমা দিয়ে ভর্তি হলাম। ‘প্রজ্ঞা ও পুণ্যের সাথে হও অগ্রসর’—এই মূলমন্ত্র নিয়ে এগিয়ে চলা এই বিদ্যাপীঠের কলেজ শাখা চালু হয় ২০০১ সালে এবং এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের বলা হয় যোসেফাইট। ভর্তির পর অরিয়েন্টেশন ডে ছিল। অরিয়েন্টেশনের দিন প্রাক্তন যোসেফাইটরা (সেন্ট যোসেফ থেকে পাস করেছে) তাদের অভিজ্ঞতা, সাফল্যের গল্পগুলো শেয়ার করেছিল। নতুন একটি সংগীতের সঙ্গে পরিচিত হলাম আর সেটি ছিল যোসেফাইট সংগীত (আমরা যোসেফাইট, যোসেফাইট আমরা)। অরিয়েন্টেশনের দিন প্রিন্সিপাল স্যার, ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার, সুদেব পাল স্যার, মিজান স্যারসহ উপস্থিত অনেক শিক্ষক অণুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন।

এই বিদ্যাপীঠের রয়েছে স্বতন্ত্র ডিজাইনের অসাধারণ একাডেমিক ভবন, যার ডিজাইনার বিখ্যাত ডিজাইনার রবার্ট বুগি। অরিয়েন্টেশন শেষে প্রথম বর্ষের নবীনদের যার যার নির্ধারিত সেকশনে শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচিতি পর্ব এবং কলেজের নিয়মকানুন সম্পর্কে অবহিত করা হলো। আমার ভর্তি সিরিয়াল ১২৭ হওয়ায় প্রথম বর্ষে আমার ক্লাস ‘মার্কারি’ সেকশনে হতো। যতদূর মনে পড়ে, কলেজের ক্লাস শুরু হতো সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে আর শেষ হতো বেলা দুইটায়। ক্লাসে দেরিতে উপস্থিত হলে লেট (দেরিতে উপস্থিত) কাউন্ট করা হতো আর নির্দিষ্ট সময়ের পরে কেউ কলেজের ভেতরে প্রবেশ করতে পারত না। অনুপস্থিতির জন্য জবাবদিহি করা হতো। প্রথম বর্ষের ক্লাস, পরীক্ষা শেষে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলাম। দ্বিতীয় বর্ষে আরেকটি সেকশন ‘ফোবোস’–এ ক্লাস হতো।

ক্লাস, পরীক্ষার পাশাপাশি ল্যাব চলত প্রতি সপ্তাহে। ল্যাবের জন্য আছে অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি, ল্যাবে এক্সপেরিমেন্টগুলো করানোর পর তার পরীক্ষা নেওয়া হতো। এরপর প্রি–টেস্ট, টেস্ট শেষে সময় হলো কলেজ থেকে বিদায় নেওয়ার। বিদায় উপলক্ষে আয়োজন করা হলো অনুষ্ঠানের। সকাল থেকে শুরু হয়ে তা চলল রাত পর্যন্ত। শিক্ষকেরা অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিলেন, পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে উঠে জাঁকজমকপূর্ণ। বিদায় অনুষ্ঠানের পর এডমিট কার্ড, রেজিস্ট্রেশন কার্ড নেওয়ার জন্য সবাই চিরচেনা কলেজে আবার উপস্থিত হয়েছিল।

প্রতিটি সেকশনে গ্রুপভিত্তিক গাইড টিচার থাকতেন, মাসিক মিটিংয়ে গাইড টিচার সকলের খোঁজখবর নিতেন। বিজ্ঞান, মানবিক এবং ব্যবসায় বিজ্ঞান বিভাগের সব সেকশনের ক্লাস প্রিফেক্টদের (ক্লাস প্রতিনিধি) নিয়ে সাপ্তাহিক/মাসিক মিটিং হতো। কলেজে নিয়মিত এসেম্বলি হতো। এসেম্বলিতে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি সবাই সমস্বরে যোসেফাইট সংগীত (আমরা যোসেফাইট, যোসেফাইট আমরা) গানটি গাইতাম। যোসেফ থেকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যারা অংশ নিয়ে সাফল্য পেত তাদের এই এসেম্বলিতে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো এবং পুরস্কার তুলে দেওয়া হতো। পরীক্ষার ফলাফলে যারা মেরিটে প্রথম সারিতে থাকত রেজাল্ট দেওয়ার দিন তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো এবং তাদের পুরস্কৃত করা হতো। এ ছাড়া যারা সর্বোচ্চ দিন ক্লাসে উপস্থিত থাকত, তাদের আলাদা সার্টিফিকেট দেওয়া হতো। আমি দুবার পেয়েছিলাম এই সার্টিফিকেট।

পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে মেধা বিকাশের জন্য বেশ কিছু ক্লাব আছে। কলেজে আরও রয়েছে, নিজস্ব ক্যানটিন, বাস্কেট বল কোর্ট, উন্মুক্ত অডিটরিয়াম, ভলিবল কোর্ট, টেবিল টেনিস কোর্ট, ক্রিকেটের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড, ফুটবল ও হ্যান্ডবল খেলার সুবিধাসমৃদ্ধ মাঠ, সুসজ্জিত লাইব্রেরি। প্রতি মাসেই ক্লাবের কোনো প্রোগ্রাম/ফেস্ট থাকত। প্রোগ্রামগুলোতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করতেন। প্রোগ্রামগুলোতে অতিথি হিসেবে গুণী মানুষদের আনা হতো। তাঁদের এনে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো। তাঁরাও আমাদের নতুনভাবে অণুপ্রাণিত করতেন।

কলেজের বিদায় শেষে শুরু হলো উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। আমরা ছিলাম এইচএসসি ২০১৭ ব্যাচ। পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট প্রকাশের পর শুরু হয় ভর্তিযুদ্ধ। সেই ভর্তিযুদ্ধে আমি ও অংশ নেই। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রিয় কলেজে গিয়েছিলাম ‘গোল্ডেন বয়েজ অনুষ্ঠানে (ভর্তি পরীক্ষায় সফল যোসেফাইটদের সম্মাননা অনুষ্ঠান)। নোবিপ্রবিতে চান্স পাওয়ায় আমিও পুরস্কৃত হয়েছিলাম। এরপর আর কলেজ প্রাঙ্গণে যাওয়া হয়নি।

কলেজজীবনে সহশিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে ভালো ধারণা হয়েছিল, যা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এসে সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করেছে। সেন্ট যোসেফ থেকে পেয়েছি, সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের পথে জীবনচলার শিক্ষা, জ্ঞান অন্বেষণের দিকনির্দেশনা।

এখন এই বিদ্যাপীঠ এ আমাদের পদচারণে নেই। তবু জ্ঞানের বিকাশে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রিয় সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। আমি কৃতজ্ঞ এই বিদ্যাপীঠের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের প্রতি যাঁরা আমাদের সব সময় অণুপ্রাণিত করতেন, তাঁদের অণুপ্রেরণাগুলো আজও আমাদের নতুন কিছু উদ্বুদ্ধ করে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এসে আজও কলেজের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। আমি গর্ব করে বলতে চাই, যোসেফাইট সংগীতের লাইনগুলো—

‘আমরা যোসেফাইট, যোসেফাইট আমরা। আমাদের মাঝে আছে সম্প্রীতি, বন্ধন গড়ে তুলেছি। সত্য, সুন্দর, ন্যায়ের পথে, জীবনচলার শপথ নিয়েছি। আমরা যোসেফাইট, যোসেফাইট আমরা।’

*safahim786786@gmail.com