ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে চোখ ও হাত বেঁধে গাড়িতে তোলা হয় জাহাঙ্গীরকে। গাড়িতে থাকা লোকজন তাঁকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ওপরের দিকে তাকিয়ে ১ থেকে ২০ পর্যন্ত গুনতে গুনতে বাঁ দিকে হেঁটে চলে যা। ডান দিকে ফিরে তাকালে মেরে ফেলা হবে।’ প্রায় পাঁচ মাস আটকে রাখার পর ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে ইতালীপ্রবাসী যুবক জাহাঙ্গীর হোসেনকে এভাবে নির্দেশনা দেন দুর্বৃত্তরা।
জাহাঙ্গীর হোসেন (২৭) গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নিজেই বাড়ি ফিরেছেন। তিনি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলা সদরের উত্তর ভবানীপুর এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবদুল হাছিবের ছেলে। ইতালি থেকে বাড়ি ফেরার সময় গত ৬ জানুয়ারি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিনি নিখোঁজ হন। পরে ৮ জানুয়ারি ঢাকার বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
আজ শুক্রবার সকালে বাড়িতে গিয়ে আলাপকালে জাহাঙ্গীর এই প্রতিবেদককে বলেন, ৬ জানুয়ারি সকালে শাহজালাল বিমানবন্দরে অভিবাসন (ইমিগ্রেশন) শেষে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে সিলেট বিমানবন্দরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় মুঠোফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বিমানবন্দরের বাইরে বের হন। পরে আর তাঁর কিছু মনে নেই। কিছু সময় পর বুঝতে পারেন, দুটি হাত পেছনের দিকে নিয়ে ও চোখ বেঁধে তাঁকে গাড়িতে তোলা হয়েছে। এ সময় তাঁর কাঁধে ঝোলানো একটি ব্যাগে পাসপোর্ট, টিকিটসহ জরুরি কিছু কাগজপত্র ছিল। এরপর তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখানে এক লোক তাঁর নাম ও ঠিকানা জানতে চান। একপর্যায়ে ওই লোক পাসপোর্টের খোঁজ করলে তিনি সেটি ব্যাগে আছে বলে জানান। পরবর্তী সময়ে তাঁকে আর কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। শুধু খাবার ও টয়লেটের সময় তাঁর চোখ খুলে দেওয়া হতো। দুবেলা খাবার জুটত।
জাহাঙ্গীর হোসেন আরও বলেন, গত বুধবার ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে চোখ ও হাত বেঁধে তাঁকে গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতে থাকা লোকজন তাঁকে নামিয়ে দিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে ১ থেকে ২০ পর্যন্ত গণনা করে বাঁ দিকে হেঁটে চলে যেতে বলে। ডান দিকে ফিরে তাকালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ওই দিন আনুমানিক রাত নয়টার দিকে একটি উড়ালসড়কের ওপর তাঁকে নামিয়ে দিয়ে লোকজন চলে যায়। ২০-২৫ মিনিট হেঁটে এক পথচারীর দেখা পান। জায়গাটা ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের কাছাকাছি। পরে বাস টার্মিনালে গিয়ে টিকিট কাউন্টারের এক লোকের মুঠোফোন দিয়ে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। স্বজনেরা বিকাশে টাকা পাঠালে টিকিট কেটে বাসে করে বাড়ি ফেরেন।
কী কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমি ২০১১ সাল থেকে ইতালিতে থাকি। স্থায়ী বাসিন্দাও হয়ে গেছি। রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কোনো সংগঠনের সঙ্গে আমি জড়িত নই। কারও সঙ্গে আমার কোনো বিরোধও নেই। তাই বুঝতে পারছি না, কেন বা কারা এ ঘটনাটি ঘটাল।’
জাহাঙ্গীরের বাবা আবদুল হাছিব বলেন, ‘আমি তো ওর আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছেলেটা ফেরায় সবাই খুশি। আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া।’
জুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জালাল উদ্দিন শুক্রবার দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীরের সন্ধান পাওয়ার বিষয়ে এখনো তিনি কিছু জানেন না। খোঁজ নিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।
পারিবার সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীর ইতালির ভেনিসে থাকেন। সেখানে তাঁর ফাস্ট ফুডের একটি দোকান আছে। গত ৫ জানুয়ারি তিনি এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি বিমানে ভেনিস থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। দুবাই হয়ে ওই ফ্লাইটটি পর দিন ৬ জানুয়ারি সকালে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছায়। ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানের অভ্যন্তরীণ একটি ফ্লাইটে ওই দিনই তাঁর সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে পৌঁছার কথা ছিল। স্বজনেরা তাঁকে আনতে সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর সিলেটে নির্ধারিত ফ্লাইটে পৌঁছাননি। পরে এমিরেটস এয়ারলাইনসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাহাঙ্গীরের ঢাকায় পৌঁছার বিষয়ে স্বজনেরা নিশ্চিত হন। এ ব্যাপারে ৮ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরের ভাই জাকির হোসেন জিডি করেন।
প্রসঙ্গত, এর আগে গত ৯ জানুয়ারি প্রথম আলো অনলাইনে ‘ইতালি থেকে ঢাকায় এসে যুবক নিখোঁজ’ শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল।