প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও-এর ৯ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। চীন ও ভারত যথাক্রমে এক ও দুই নম্বরে আছে।
দুই বছর আগে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। এবার বড় ধরনের অগ্রগতির পেছনে মূল অবদান ছিল ইলিশের।
দ্য স্টেট অব ফিশ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০১৮ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, চাষের ও প্রাকৃতিক উৎসের মাছ মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন চতুর্থ। চার বছর ধরে বাংলাদেশ এই অবস্থানটি ধরে রেখেছে। আর শুধু চাষের মাছের হিসাবে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।
এফএও এবং বাংলাদেশের মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী-হাওর-বাঁওড়-বিল ও অন্যান্য উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরণ করা মাছের উৎপাদনে বাংলাদেশের উন্নতির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি। প্রাকৃতিক উৎস থেকে বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ১০ লাখ ৪৮ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ইলিশ ছিল প্রায় ৫ লাখ টন। জাটকা নিধন বন্ধে নেওয়া সরকারের নানা উদ্যোগ ও ইলিশের নতুন নতুন অভয়ারণ্য সৃষ্টির ফলে তিন বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দেড় লাখ টন বেড়ে গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সাতটি দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অর্ধেকেরও বেশি আসে মাছ থেকে। প্রাণিজ আমিষের ৫৮ শতাংশ মাছ দিয়ে মিটিয়ে শীর্ষস্থানীয় দেশের কাতারে এখন বাংলাদেশ। যেখানে বিশ্বে গড়ে প্রাণিজ আমিষের ২০ শতাংশ আসে মাছ থেকে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় মাছের মজুত নির্ধারণের ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা দিতে এফএওর একটি দল বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদের দলনেতা এফএওর এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের কর্মকর্তা সুসানা সিয়ারের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি মিষ্টি পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের এই সাফল্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ ছাড়া ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের সাফল্য এই অবস্থানে আসতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
অবদান রেখেছে মাছের ৬০ প্রযুক্তি
বাংলাদেশ মৎস্য ইনস্টিটিউট থেকে ইতিমধ্যে মৎস্য চাষ ও ব্যবস্থাপনা-বিষয়ক ৬০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ১৮টি মাছের পোনা উৎপাদন করেছে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া তাঁরা কই মাছের রোগ প্রতিরোধে টিকা উদ্ভাবন করেছেন।
ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত এসব প্রযুক্তি মৎস্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের ফলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে মাছের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। আর শুধু তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ (প্রায় ৪ লাখ মে. টন) এবং এশিয়াতে তৃতীয়।
বাধা পেরিয়ে সাফল্য
মিষ্টি পানির মাছ আহরণ ও চাষে বাংলাদেশের এই সাফল্য এসেছে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে। মৎস্য চাষে বাংলাদেশে কিছু ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। দেশের ১২ শতাংশ মানুষ মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত হলেও এই খাতে আর্থিক প্রণোদনা পান শুধু রপ্তানিকারকেরা। চাষিরা তেমন কোনো সরকারি সহযোগিতা পান না। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে মৎস্য খাত কৃষির আওতায় পড়ে। কিন্তু মৎস্যচাষিরা কৃষিঋণের মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পান। ধান ও অন্যান্য ফসল চাষের জন্য কৃষকেরা ডিজেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি পান। মাছচাষিরা তা পান না।
আরেকটি সমস্যা এ খাতের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেশের চার ধরনের মাছের উৎপাদন খরচ এবং দাম প্রায় সমান। অর্থাৎ মাছের খাবার ও অন্যান্য উপকরণ খরচের বিপরীতে যে দামে চাষিরা মাছ বিক্রি করেন তাতে তাঁদের লাভ তো দূরে থাক, অনেক ক্ষেত্রে লোকসান গুনতে হচ্ছে। বিশেষ করে থাই কই, তেলাপিয়া, রুই, পাঙাশ মাছ চাষ করে চাষিরা লাভ-লোকসানের মাঝামাঝি ঝুলছেন।
আবার উৎপাদন বেশি হলে তা মজুত করতে ধান, গম, পাট ও আলুর জন্য গুদাম ও হিমাগার আছে। কিন্তু মাছচাষিদের জন্য কোনো হিমাগার এখনো নির্মিত হয়নি।
বাংলাদেশে মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. আরিফ আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মাছচাষিরা বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত জাতগুলো সঠিকভাবে চাষ করে আজকে দেশের মৎস্য খাতকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু মাছের খাবার ও পুকুরে সেচসহ অন্যান্য খাতে জ্বালানির অর্থ জোগাড় করতে তাঁদের যে পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে তা আর বেশি দিন বহন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। মাছের খাবারের দাম কমানো, মৎস্যচাষিদের কৃষিঋণ দেওয়া ও জ্বালানিতে তাঁদের ভর্তুকি দিতে না পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তখন বিশ্বে দেশের সম্মান যেমন যাবে, তেমনি গরিব মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
মাছের দাম বাড়েনি
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর হিসাবে গত এক বছরে দেশের চাল, ডাল, তেল, আটাসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। একমাত্র মাছের দাম তেমন বাড়েনি। তিন বছরের তুলনা করলে দেখা যাবে দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু মাছের খাবার বা ফিড, খামারে ব্যবহারের বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম বেড়েছে।
এফএওর হিসাব অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে এক যুগ ধরে মাছ চাষে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ভারতকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল। ২০০৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাছের উৎপাদন ৫৭ শতাংশ বেড়েছে।
এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের সাধারণ মৎস্যচাষি, বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণকর্মীদের যৌথ প্রয়াসে মৎস্য চাষে এই সাফল্য এসেছে। মাছের খাবারের দাম কমানোসহ অন্য যেসব সমস্যা রয়েছে তা দূর করতে আমরা সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি।’
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে, বর্তমানে দেশের জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপিতে ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
মাছ খাওয়া বেড়েছে
মাছের দাম সাধারণ ক্রেতাদের সামর্থ্যের মধ্যে থাকায় গত ১০ বছরে দেশে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ প্রায় শতভাগ বেড়েছে। ২০১০ সালের সর্বশেষ খানা জরিপ অনুযায়ী বছরে বাংলাদেশের একেকজন মানুষ প্রায় ১২ কেজি মাছ খায়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বিলুপ্তপ্রায় ছোট মাছগুলো আবারও সাধারণ মানুষের খাবারের টেবিলে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আমাদের উদ্ভাবিত চাষপদ্ধতির কারণে আজকে টেংরা, গুলশা, পাবনা, শিং ও মাগুর মাছের উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। এসব মাছের কেজি আগে ৮০০ টাকার নিচে পাওয়া যেত না। এখন তা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় নেমে এসেছে। এমন আরও ১৮টি মাছের আধুনিক চাষপদ্ধতি ও মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে আমরা গবেষণা করছি। আশা করি, এতে চাষিদের মাছের দাম না পাওয়ার দুঃখ দূর হবে। বিশ্বে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ আরও এগোবে।’