বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির যোবায়ের আহমেদ আনসারী মারা যান ১৭ এপ্রিল সন্ধ্যা পৌনে ৬টায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মারকাজপাড়ায় তিনি মারা যাওয়ার ঘণ্টা দু-এক পরই পরিবারের সদস্যরা মৃতদেহ দাফন করতে সরাইলের বেড়তলায় রওনা হয়ে যান। পরিবারের দাবি, লকডাউনের মধ্যে জনসমাগম যেন না হয়, সে জন্যই তাড়াহুড়ো করে তাঁরা শহর ছাড়েন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
মাওলানা যোবায়ের আহমেদ আনসারীর ভাই মো. আমানুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, জনসমাগম অনিচ্ছাকৃত। তাঁরা দুঃখিত।
মাওলানা যোবায়ের আহমেদ জামিয়া রাহমানিয়া বেড়তলা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। মো. আমানুল্লাহ এই মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। আমানুল্লাহ প্রথম আলোকে আরও বলেন, জানাজার খবর পেয়েই সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁদের জনসমাগম না করার নির্দেশ দেন।
প্রচুর লোক হয়ে যাওয়ার পর হ্যান্ডমাইকে বারবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ঘোষণাও দেয় পুলিশ। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। সামাল দিতে তাঁরা নির্ধারিত সময়ের আগে জানাজা পড়েন এবং কাউকে আর মৃতদেহ দেখতে দেননি। আজ রোববার পুলিশ সদর দপ্তর তিন সদস্যের যে কমিটি গঠন করেছে, সে কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। কমিটির সদস্যরা জামিয়া রাহমানিয়া বেড়তলা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। কমিটিকেও পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন এই কথা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র প্রথম আলোকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
ওই জানাজায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, মাওলানা যোবায়ের আহমেদ আনসারী মারা যাওয়ার পর থেকেই পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হচ্ছিল। জনসমাগম করার ইচ্ছে থাকলে তাঁরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রীতি অনুযায়ী জেলার ঈদগাহ মাঠে জমায়েত করতে পারতেন। তার বদলে তাঁরা মাদ্রাসা–সংলগ্ন ছোট্ট একটি ঈদগাহ মাঠে জড়ো হন। ওই মাঠে সাত-আট কাতারের বেশি মানুষ নামাজ পড়তে পারে না। যা কিছু ঘটেছে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনিচ্ছাকৃত।
আসলে ঠিক কী ঘটেছিল, জানতে যোবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন এমন তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর।
তিনজনের দুজনই বলেছেন, তাঁরা ভেবেছিলেন লকডাউনের মধ্যে তাঁরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানাজা পড়তে যাবেন না। লকডাউনের মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে দিনে একবার তাঁরা বের হন। ওই দিনও একবার বের হয়ে জানাজা পড়ে ফিরবেন, এমনই ছিল ইচ্ছা। ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাঁরা নিজেরাই তাজ্জব হয়ে যান।
মাওলানা ইয়াসীন আরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, যোবায়ের আহমেদ আনসারী অনেক দিন ধরেই ক্যানসারে ভুগছিলেন। দেশের বাইরে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। শহরের বাসায় তাঁর মৃত্যুর খবর তিনি পান লোকমুখে। এ ছাড়া ফেসবুকেও তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে যায়। তিনি স্থানীয় আলেম-ওলামাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। নিজের ইচ্ছাতেই মাদ্রাসার খাদেমদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাজায় হাজির হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
লকডাউনের মধ্যে জানাজায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন? জানতে চাইলে ইয়াসীন আরাফাত বলেন, দিনে একবার তিনি বাজার করতে বের হন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে সরাইল দূরে হলেও তিনি ভেবেছিলেন রাস্তাঘাট ফাঁকা, দ্রুতই পৌঁছে যেতে পারবেন। কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে, কিছুটা মোটরসাইকেলে করে তিনি জানাজাস্থলে পৌঁছান।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জানাজা কোথায় কখন হবে, সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা যোবায়ের আহমেদ আনসারীর পরিবার বা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দেয়নি।
জানাজায় অংশগ্রহণকারী অপর ব্যক্তি মাওলানা আশরাফুল ইসলাম বলেন, মসজিদের মাইকে যোবায়ের আহমেদ আনসারীর মৃত্যুসংবাদ প্রচারের পাশাপাশি জানাজায় অংশ না নিতেও অনুরোধ করা হয়েছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও মাইকিং করা হয়। তারপরও তিনি ‘আবেগে’ চলে গেছেন।
জানা গেছে, যোবায়ের আহমেদ আনসারীর ভক্ত-অনুরাগীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাইরেও বিশেষত হবিগঞ্জ ও নরসিংদীতে রয়েছেন। জানাজায় বাইরের জেলার লোকের উপস্থিতি ছিল কি না, সে সম্পর্কে কেউ বলতে পারছেন না। তবে, মোটরসাইকেল, রিকশা বা অটোরিকশায় ভেঙে ভেঙে অনেকে জানাজায় অংশ নেন। মহাসড়কে অল্প যে দু-চারটি যান চলাচল করে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যায়।