২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর। তারাকান্দা উপজেলার গোয়ালকান্দি গ্রামের গৃহবধূ পারভীন আক্তারের প্রসব বেদনা শুরু হয়। বাড়ি থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরে নেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির পাশের কমিউনিটি ক্লিনিকে। প্রসব বেদনা বাড়তে থাকায় উপায়ান্তর না পেয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার পলি রানি মোদক সাহসী এক সিদ্ধান্ত নেন। ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনুমতি নিয়ে একজন প্রশিক্ষিত ধাত্রীকে খবর দিয়ে এনে নিজের কমিউনিটি ক্লিনিকেই পারভীনের সন্তান প্রসব করান তিনি।
ক্লিনিকে যখন পারভীনের সন্তান প্রসবের প্রক্রিয়া চলছিল, তখন ক্লিনিকের বাইরে ছিলেন উৎকণ্ঠিত কিছু গ্রামবাসী। তাদের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলোতেও। সেই থেকে শুরু। এরপর গত দুই মাসে আরও চারজন নারীর সন্তান প্রসব হয় গোয়ালকান্দি কমিউনিটি ক্লিনিকে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ প্রোভাইডার পলি রানি মোদক জানান, প্রথম সন্তান প্রসব করানোর কাজটি ছিল চ্যালেঞ্জের। প্রসব বেদনা নিয়ে যাওয়ার মতো কাছাকাছি কোনো হাসপাতাল না থাকায় তিনি কমিউনিটি ক্লিনিকেই প্রসবের কথাটি চিন্তা করেন। কাজটি যেহেতু ঝুঁকির, কাজেই তিনি ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা প্রাণেশ কুমার পণ্ডিতকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি সাহস দিয়ে বলেন, ‘আমরা যেন সন্তান প্রসবের কাজ শুরু করি। সামান্যতম সমস্যা হলেই সঙ্গে সঙ্গে যেন তাঁকে জানাই। তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রেখেছেন।’
গোয়ালকান্দি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীন।
পলি রানি মোদক আরও জানান, ১৯ নভেম্বর পারভীনের সন্তান প্রসবের পর যেন আশায় বুক বেঁধেছেন গ্রামবাসী। এরপর আরও চারজন নারীর সন্তান প্রসব হয় গোয়ালকান্দি কমিউনিটি ক্লিনিকে। সন্তান প্রসব করা এই চার মা হলেন রামপুর গ্রামের বাসনা আক্তার, গোয়ালকান্দি গ্রামের মাহমুদা বেগম, সিংহেরকান্দা গ্রামের শিল্পী বেগম ও সোমা আক্তার।
এসব মায়ের নাম একটি খাতায় নিবন্ধন করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পলি রানি। এ ছাড়া সন্তান প্রসবকালীন সময়ের ছবি ও সন্তানের সঙ্গে মায়েদের ছবি ক্লিনিকের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি ও ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন গ্রামবাসী।
গত শনিবার তারাকান্দার গোয়ালকান্দি গ্রাম ও কমিউনিটি ক্লিনিকে কথা হয় কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে। তাঁরা জানান, গোয়ালকান্দি ও আশপাশের হিরারকান্দা, সিংহেরকান্দা গ্রামের মানুষ এই কমিউনিটি ক্লিনিকে যান। গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়া পাকা সড়কের একপাশে ৬ কিলোমিটার দূরে তারাকান্দা উপজেলা সদর। পাকা সড়কের অপর প্রান্তে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার শ্যামগঞ্জ বাজার। তারাকান্দা ও শ্যামগঞ্জে নেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। স্বাস্থ্যসেবার জন্য মানুষকে যেতে হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গ্রামের মানুষের পক্ষে টাকা খরচ করে দূরের হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হয় না। কাজেই ছোটখাটো অসুখে এখন গোয়ালকান্দি কমিউনিটি ক্লিনিকই তাঁদের ভরসা। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে খোলা থাকে কমিউনিটি ক্লিনিকটি।
শনিবার দুপুরে দেখা যায়, গোয়ালকান্দি কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে অন্তত ২০ জন নারী অপেক্ষমাণ। তাঁদের বেশির ভাগের কোলে শিশু। শিশুরা ঠান্ডাজনিত অসুখে ভুগছে। একই সঙ্গে বৃদ্ধারাও ঠান্ডাজনিত অসুখে আক্রান্ত। তবে কারোর বড় কোনো অসুখ হলে যেতে হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গোয়ালকান্দি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নেন। বর্তমানে ক্লিনিকটির ছাদে ও দেয়ালে কিছু অংশে ছোট ছোট ফাটল দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া ক্লিনিকে বিদ্যুৎ–সংযোগ নেই।
স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা চারজন নারী জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার পলি রানি রোগীদের প্রতি খুব আন্তরিক। তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বাড়িতে গিয়ে ও ফোনে নিয়মিত খোঁজ রাখেন। ক্লিনিকে সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি।
১৯৯৮ সালে গোয়ালকান্দি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপিত হয়। গোয়ালকান্দি গ্রামের আবদুর রহিম তালুকদার ক্লিনিকের জন্য পাঁচ শতক জমি দান করেন। তিনি বর্তমানে ক্লিনিকের পরিচালনা কমিটির সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের মানুষের শহরে গিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। কমিউনিটি ক্লিনিকটিই এখন সবার ভরসা।
ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা প্রাণেশ কুমার পণ্ডিত বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকে সন্তান প্রসব করানো খুবই সাহসী কাজ। গোয়ালকান্দি কমিউনিটি ক্লিনিকের এ কাজটির জন্য আমরা তাদের প্রশংসা করি। পাশাপাশি আমরা সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছি।’