বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের মধ্যে দুজন ব্যাংক কর্মকর্তা।
সিআইডি বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই চক্রটি তিন ভাগে কাজ করত। এক ভাগের দায়িত্ব ছিল ছাত্র সংগ্রহ করা, একটি ভাগ ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের সমাধান করত এবং আরেক ভাগ পরীক্ষার কেন্দ্র দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ছিল।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন প্রশ্ন জালিয়াত চক্রের ‘দ্বিতীয় প্রধান’ অগ্রণী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মানিক কুমার প্রামাণিক (৩৮), জনতা ব্যাংকের ঢাকার দিলকুশা শাখায় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. রাকিবুল হাসান ওরফে শান্ত (২৫), তাঁদের সহযোগী রাশেদুজ্জামান ওরফে সজীব (৩৬), হাসান মাহমুদ (২২), মো. শফিকুল ইসলাম (৩০), রিপন কুমার (২৬)। মানিক প্রামাণিকের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, চারটি ডায়েরি ও একটি নিশান গাড়ি জব্দ করা হয়।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. কামরুল আহসান। তিনি বলেন, চক্রের সদস্যরা এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকের দুবারের নিয়োগ পরীক্ষা, ২০১৯ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটের ২০১৭ ও ২০১৮ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে।
মো. কামরুল আহসান বলেন, ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে তেজগাঁওয়ের সরকারি বিজ্ঞান কলেজের কেন্দ্র থেকে পরীক্ষার্থী নাফিউল ইসলাম ওরফে তাহসিনকে মুঠোফোনসহ আটক করা হয়। এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে তেজগাঁও থানায় মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র সম্পর্কে তথ্য পায় সিআইডি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আটক তাহসিনের কাছে পাওয়া ডিভাইসের তথ্য পর্যালোচনা করে গত ২২ ডিসেম্বর রাজধানীর মালিবাগ এলাকা থেকে হাসান মাহমুদ ও তাঁর খালাতো ভাই রাশেদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাশেদুজ্জামান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রাশেদুজ্জামান সিআইডিকে জানান, তিনি একটি কোচিং সেন্টারের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। এই চক্রে তাঁর কাজ ছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ইংরেজি অংশের সমাধান করা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হাসান মাহমুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রাকিবুল হাসানের মাধ্যমে রাশেদুজ্জামান এই চক্রে যুক্ত হন। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, ২৭ ডিসেম্বর বিকেলে মতিঝিল থেকে রাকিবুল হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাকিবুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। তিনি চলতি বছরে জনতা ব্যাংকের দিলকুশা শাখায় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। তিনি রাশেদুজ্জামানকে দিয়ে প্রশ্নপত্র সমাধানের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
কামরুল আহসান বলেন, রাকিবুল হাসানের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে ব্যাংক কর্মকর্তা মানিক কুমার প্রামাণিকের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর গতকাল বুধবার রাত সাড়ে তিনটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে রাজশাহীর মোহনপুর থানা এলাকা থেকে মানিক কুমার প্রামাণিক, তাঁর সহযোগী সাদিকুল ইসলাম ও রিপন কুমারকে গ্রেপ্তার করা হয়। মানিক কুমার প্রামাণিক রাজশাহীতে অগ্রণী ব্যাংকে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ও প্রশ্নপত্র সমাধানের জন্য বিভিন্নজনের কাছ থেকে তিনি ৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছেন। সেখানে তিনি সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। মানিক কুমার প্রামাণিককে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার অনেক আগে থেকেই ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন এবং পরীক্ষা চলাকালে তাঁরা ডিজিটাল ডিভাইসে সহায়তা করতেন। এই চক্রে ১০ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রের মূল হোতাসহ বাকিদের গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে। যাঁরা জালিয়াতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের ছাত্রত্ব ও নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মানিক কুমার প্রামাণিককে জিজ্ঞাসাবাদে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। যাঁরা জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং চাকরিতে যোগদান করেছেন, তাঁদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম বলেন, এই চক্রটি হোয়াটস অ্যাপে গ্রুপ খুলত। তাতে যাঁরা অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কিংবা চাকরি নিতে চান, তাঁরা যুক্ত হতেন। পরে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পরীক্ষার ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিতেন। পরে চক্রের সদস্যরা সমাধান করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছেড়ে দিতেন।
এর আগে ২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিটে প্রশ্ন জালিয়াতির ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা আইনে হওয়া মামলায় ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৪৬ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের গোয়েন্দা শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ, সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের গণমাধ্যম শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক।