পরিবার নিয়ে অর্থকষ্টে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী ও রাষ্ট্রপক্ষের এক নম্বর সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার। নিদারুণ কষ্টের কথা প্রধানমন্ত্রীকে বলতে ১৩ দিন ধরে মাহবুবুল আলম ঢাকায়। এর আগেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পেতে ঢাকায় এসেছিলেন।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত।
আজ মঙ্গলবার বেলা দেড়টায় প্রথম আলোকে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গণভবনের সামনে আছি।’ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পেলে তিনি সেখানেই অবস্থান করবেন বলে জানান।
১৩ নভেম্বর পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন মাহবুবুল আলম হাওলাদার। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য মন্ত্রী-সাংসদসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের কাছে দেনদরবার করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর দুর্বিষহ জীবনের কথা বলতে চান।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মাহবুবুল আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা করে তিনি প্রধান সাক্ষী হয়েছিলেন। সে মামলায় সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়। কিন্তু এখন তাঁর নিজের জীবনই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে অর্থকষ্টে। গত চার বছরে প্রায় আট লাখ টাকা তাঁর ধারদেনা হয়ে গেছে।
সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (ইন্দুরকানি উপজেলা) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বলেন, ‘আমার আয় বলতে ১২ হাজার টাকা মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা। আমি ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগী। সাড়ে তিন হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এই টাকায় আমার সংসার, সন্তানদের পড়ালেখা চলছে না। কিন্তু লোকলজ্জায় কাউকে বলতেও পারি না।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে মাহবুবুল আলম এই বলে আবেদন জানিয়েছেন, ‘হাজার যন্ত্রণার চেয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মারা যাওয়া অনেক ভালো ছিল। আমি মানুষের মতো বাঁচতে চাই। ’
মাহবুবুল আলমের ভাষ্য, তাঁর নিরাপত্তায় সরকারের দেওয়া পুলিশ সদস্যেদের কারণে তিনি দৈনন্দিন জীবন চলা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ২০১৩ সালে ২৮ অক্টোবর তাঁর পিরোজপুরের ইন্দুরকানির বাড়িতে জামায়াত-শিবিরের লোকজন হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এরপর সে বছরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী সুরক্ষা আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষীদের জানমালের নিরাপত্তায় পুলিশ নিয়োগ করে রাষ্ট্র। কিন্তু পুলিশনির্ভর তাঁর স্বাভাবিক জীবন পাল্টে দিয়েছে। রাস্তাঘাটে চলাফেরা, হাটবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, বেড়ানো, সামাজিকতা—সবটাই বদলে গেছে।
মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমার বসতঘরের সামনের রুমটি পুলিশ ক্যাম্প। আমার নিরাপত্তার জন্য চারজন পুলিশ থাকে। ঘরের লোকদের গোপনীয়তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা বলতে কিছু আর নেই। পুলিশ ছাড়া কোথাও বের হওয়া যায় না। সামান্য বাজার করতে গেলেও সঙ্গে পুলিশ নিতে হয়। যেখানে হেঁটে যাওয়া যায়, সেখানে দুইটা রিকশা নিতে হয়। তাতে মাসে যাতায়াত খরচ হয় অন্তত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আমার এই যন্ত্রণা কে দেখবে?’
মাহবুবুলের ভাষ্য, তিনি গত পাঁচ-ছয় বছরে স্থানীয় সাংসদ, মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে বারে বারে গেছেন। কিন্তু কারও সহযোগিতা পাননি, সবাই কেবল আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁর কোনো খোঁজখবর রাখেননি। বরং অনেকে জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করছেন। এসব বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্যের কারণে ইতিমধ্যে তিনি অনেকের বিরাগভাজন হয়ে গেছেন।
মাহবুবুল আলম হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ বার ঢাকায় এসেছি। অফিশিয়ালি বলেছি, চিকিৎসা ও দাপ্তরিক কাজে আমি ঢাকা যাচ্ছি। কিন্তু এসেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ঢাকায় যাতায়াত খরচই হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছি। এবার আমি দেখা না করে ফিরব না।’