প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শুভকামনা জানিয়েছেন আট বিভাগ থেকে আটজন এজেন্ট ও হকার। প্রথম আলোকে নিয়ে তাঁদের ভালো লাগা ও প্রত্যাশার কথাও লিখেছেন।
মো. মোফাজ্জল হোসেন
হকার নেতা, রংপুর
ছোটবেলা থেকেই পরিবারে অভাব–অনটন ছিল। একপর্যায়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলতে হয় আমাকে। আয়–রোজগার করতে কুড়িগ্রাম থেকে রংপুরে ছুটে আসি। কিন্তু কী করব, দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ঠিক এমন এক সময় দেখা মিলল পত্রিকা ব্যবসায়ী হান্নান ভাইয়ের সঙ্গে। সময়টা ১৯৯১ সাল, ৩০ বছর আগের কথা। নিজেকে বদলানোর জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম।
হান্নান ভাই বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করার কাজ দিলেন। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে প্রথম আলো পত্রিকা বাজারে এল। এই পত্রিকার প্রতি পাঠকের আগ্রহ শুরু থেকেই ছিল। একটা সময় প্রথম আলোর বিক্রি বাড়তে থাকে। আমার আয়ও বাড়ছিল। আমিও প্রথম আলোর পিছু ছাড়িনি। প্রতিদিনই দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো যেভাবে বদলের গল্প বলছে, ঠিক তেমনই আমিও এই পত্রিকা বেচে আমার জীবন বদলাতে শুরু করি। এই বদলের পেছনের গল্পের বড় অংশীদার প্রথম আলো।
প্রথম আলোর চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পর একটা সময় দেখা গেল, ঢাকা থেকে ছাপা হয়ে পত্রিকা দেরিতে আসছে। এতে পাঠক বিরক্ত হতো। এমনও দিন গেছে, এক দিনের পত্রিকা পরদিন পাঠকের হাতে পৌঁছে দিয়েছি।
তবে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ বসে থাকেনি। পাঠকের চাহিদার কথা চিন্তা করে বগুড়ায় ছাপাখানা বসিয়ে এখানেই পত্রিকা ছাপানোর কাজ শুরু করল। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই পত্রিকা রংপুর প্রেসক্লাব চত্বরে আসতে শুরু হলো। আমিও ছুটে আসি। পত্রিকা নিয়ে ছুটে চলি পাঠকের বাড়ি বাড়ি। এত সকালে কাগজ পেয়ে পাঠকেরা তো মহাখুশি। সেই সঙ্গে আমার ব্যবসাও ভালো হতে থাকে। আয়–রোজগার বেড়ে যায়।
প্রথম আলো পত্রিকা বিক্রি করে আমার পরিবারের অভাব কিছুটা ঘোচাতে পেরেছি। কর্মচারী থেকে মালিক হয়েছি। রংপুরের মতো একটি বিভাগীয় শহরে পত্রিকা বিক্রি করে একখণ্ড জমি কিনেছি। ঘর করে বসবাস করছি। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে! প্রথম আলো বিক্রি করে হকারদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। হকাররা আমাকে ভোলোবেসে হকার সমিতির সাধারণ সম্পাদক করেছেন। আমি হকারদের কাছে কৃতজ্ঞ।
আমার এত সব উন্নতির জন্য প্রথম আলো পত্রিকার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। আজ প্রথম আলোর ২৩ বছরের দীর্ঘ পথচলায় সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রথম আলোর সঙ্গে আছি এবং থাকব। ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানাই। প্রথম আলোই আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা।
মোহাম্মদ আইয়ুব খান
স্বত্বাধিকারী, ইব্রাহিম এজেন্সি, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড়ের কাছে কে সি দে রোডের ইব্রাহিম এজেন্সির নাম পত্রিকার জগতের মানুষের কাছে পরিচিত। প্রতিদিন ভোরবেলা শত শত হকারের আগমনে লালদীঘির পাড় মুখর হয়। আমি সেই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ১৯৯০ সাল থেকে। আমার দীর্ঘ ৩১ বছরের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে কঠিন সময় এসেছে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ। এ সময় করোনা মহামারির কারণে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়। সব হকার বাড়িতে চলে যান, আমি ভেঙে পড়ি। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কোনো হকার পত্রিকা নিচ্ছেন না। পত্রিকার বিলির কেন্দ্রটি খোলা রাখা কঠিন হয়ে গেল। এত কম পত্রিকা চললে কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে।
সেই মুহূর্তে আমি প্রথম আলোর সার্কুলেশন–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলি এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি। তারপর আমি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে এ মুহূর্তে কোনোভাবে অফিস কিংবা পত্রিকা কেন্দ্র সম্পূর্ণ বন্ধ করা ঠিক হবে না। কারণ, আমি নিজে যদি ভেঙে পড়ি কিংবা সব বন্ধ করে চলে যাই, তাহলে এ ব্যবসা, পত্রিকার সার্কুলেশন এবং হকার ফিরিয়ে আনা আর কখনো সম্ভব হবে না।
পরদিন কয়েকজন হকার ও সুপারভাইজারকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই সেন্টারে আসি। তখন আমার পত্রিকা প্রায় ৮৫ ভাগ কমে গিয়েছিল। খুব ভোরে সেন্টারে আসার সময় একটি রিকশাও পাচ্ছিলাম না। আবার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলাম। কারণ, আবাসিক এলাকার গেটগুলো পুরোপুরি বন্ধ ছিল। প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে আসতাম ভোরের আলো ফোটার আগে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা ছিল, যেভাবেই হোক সুদিন ফিরিয়ে আনব। এর মধ্যে প্রত্যেক হকারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছিলাম। তাঁদের কাজে ফিরে আসার জন্য উত্সাহ দিয়ে যাচ্ছিলাম।
এভাবে ধীরে ধীরে আমার হকার ভাইয়েরা একজন একজন করে সবাই ফিরে আসতে শুরু করেন। এর মধ্যে আমরা আবাসিক এলাকা, মার্কেট এলাকায় পত্রিকা নিয়মিত করার জন্য প্রথম আলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করি। আস্তে আস্তে একটি একটি করে পত্রিকা চালু হয়, আর আমার মনে আশার আলো সঞ্চারিত হয়। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৬৫ ভাগ পত্রিকা আমি ফিরে পেয়েছি। আর এখনো আমি স্বপ্ন দেখি, আগামী বছর আমার ১০০ ভাগ পত্রিকা ফিরে পাব। আর এ জন্য প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই নিয়মিত সহযোগিতার জন্য।
নগেন দাস
পত্রিকা বিক্রেতা, মানিকগঞ্জ
সাত ভাইবোন নিয়ে দরিদ্র বাবার সংসার আর চলছিল না। অর্থকষ্টে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি ছাড়াতে পারিনি। তাই অল্প বয়সে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করি। ভালো লাগা ও ভালোবাসা থেকেই এখনো সেই হকারের কাজই করে যাচ্ছি। এখন দিন ঘুরেছে, আর আর্থিক কষ্ট নেই।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ৫৮ বছর বয়সেও আমি সাইকেলে করে মানিকগঞ্জের আদালত চত্বর, ডিসি অফিসসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পাঠকের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিই। দুই বছর আগে আমার ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়ার পরও পত্রিকার প্রতি ভালোবাসা থেকে আমি থেমে থাকিনি। কৃষক বাবার সংসারের পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। এ কারণে পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর সংসারের হাল কিছুটা হলেও ধরতে হয়। বর্তমানে জেলা শহরের পোড়রা এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছি।
১৯৯৮ সালের নভেম্বরে প্রথম আলো পত্রিকা বের হয়। পাঠকদের কাছে পত্রিকাটি নিয়ে আমরা হাজির হলাম। অনেক পাঠক বেশ আগ্রহ নিয়ে পত্রিকাটি কিনতে শুরু করেন। বছর না যেতেই প্রথম আলোর পাঠক বাড়তে থাকে। আমরা পত্রিকাটির সংখ্যা বাড়াতে থাকলাম। আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যেই প্রথম আলোর পাঠকসংখ্যা অন্যান্য পত্রিকা থেকে বেশি হয়ে গেল। প্রথম আলো বিক্রি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আয়ও বাড়ল। পাঠক বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল, পত্রিকাটি সব শ্রেণির পাঠকের জন্য আলাদা কিছু রেখেছিল।
আমি ১৭ বছর বয়সে পত্রিকার হকারের কাজ শুরু করি। প্রায় ৪২ বছর ধরে ঘুরে ঘুরে পত্রিকা বিক্রি করে আসছি। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রথম আলো সব সময় অন্যদের তুলনায় হকারবান্ধব এবং সব সময় দুঃসময়ে প্রথম আলো আমাদের পাশে ছিল। করোনাভাইরাসের সময় কোর্ট–কাচারিসহ সব অফিস বন্ধ থাকায় পত্রিকার বিক্রি একেবারেই কমে যায়। তবে সংক্রমণ কমে যাওয়ায় এখন পত্রিকা বিক্রি অনেকটা বেড়েছে। যদিও করোনার আগের মতো আর বিক্রি হয় না। অনেকে অনলাইনে পত্রিকা পড়েন।
কয়েক বছর ধরে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হকার ও এজেন্টদের মিষ্টিমুখ করানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে চমকপ্রদ উপহার পেয়েছি। প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অভিনন্দন জানাই।
তারা মিয়া
সংবাদপত্র বিক্রেতা, ময়মনসিংহ
স্বাধীনতার আগের কথা। তখন জামালপুর শহরের থাকতাম। জামালপুর থেকে প্রতিদিন ট্রেনে চলে আসতাম ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ থেকে সংবাদপত্র কিনে আবার ট্রেনে চলে যেতাম গৌরীপুর রেলওয়ে স্টেশনে। সারা দিন ঘুরে ঘুরে সংবাদপত্র বিক্রি করে ট্রেনে করে গৌরীপুর থেকে আবার ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে করে জামালপুর। তখন আমার বয়স খুব কম। এরপর একাত্তরে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। তখন পত্রিকা বিক্রি বন্ধ ছিল।
আমার বাবা রেলওয়ের কর্মচারী ছিলেন। স্বাধীনতার পর বাবা বদলি হয়ে আসেন ময়মনসিংহে। তখন আমরা ময়মনসিংহে বসবাস শুরু করি। পাঁচ ভাই, চার বোন আমরা। সংসার ছিল অভাব-অনটনের। ময়মনসিংহে আসার পর আবার সংবাদপত্র বিক্রি করতে শুরু করি। ময়মনসিংহে তখন সংবাদপত্রের এজেন্ট ছিলেন আবদুস ছালাম। তাঁর কাছ থেকে সংবাদপত্র সংগ্রহ করে শহরের তাজমহল মোড়ে বিক্রি করতাম।
এখন আমার বয়স ৬০ পেরিয়েছে। ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপে ভুগছি। স্মৃতিশক্তি কমে গেছে। সংসারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আর বিয়ে করা হয়নি। সংবাদপত্র বিক্রির কাজটিকে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রতিদিন সকালে মানুষ সংবাদপত্র হাতে নিয়ে দিন শুরু করে। এ জন্য আমার গ্রাহকেরা আমার ওপর নির্ভর করেন। তাই কোনো দিন নিজের কাজ বন্ধ রাখিনি। প্রতিদিন যাঁরা সংবাদপত্র প্রকাশ করেন, তাঁরা যেমন এক দিনের জন্য কাজ বন্ধ রাখেন না, আমিও তেমন।
বিয়ে না করায় আমার কোনো সংসার নেই। সংবাদপত্রই আমার সংসার। সে সংসার বড় অভাবের। ময়মনসিংহ শহরে আমার কোনো বাড়ি নেই। অন্যের জায়গায় বসবাস করি। কোনো রকমে দুই বেলা নিজেই রান্না করে খাই। সংবাদপত্রই আমার সংসার। যত দিন বেঁচে আছি, সংবাদপত্র নিয়েই থাকব, প্রথম আলোর সঙ্গেই থাকব।
দেখতে দেখতে প্রথম আলো ২৩ বছর পর করেছে। প্রথম আলোর সঙ্গে থাকতে পেরে আমিও গর্বিত। কারণ, প্রথম আলোই পাঠকের প্রথম পছন্দ। প্রথম আলো শুরু থেকেই সবসময় সত্য প্রকাশ করে। এই পত্রিকাটির অনুসন্ধানী ও সৃজনশীল সাংবাদিকতা পাঠকের কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের। এ কারণেই প্রথম আলো শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে পাঠকপ্রিয়।
প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি সম্পাদকসহ পত্রিকাটির সকল সাংবাদিক, কর্মকর্তা–কর্মচারী, লেখক ও অগণিত পাঠকদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা।
সিকান্দর আলী
স্বত্বাধিকারী, উদয়ন নিউজ এজেন্সি, সিলেট
একটি দলনিরপেক্ষ পত্রিকা হিসেবে প্রথম আলোর পাঠক হয়েছিলাম। দুই যুগ হতে চলল, সেই শুরুর মতোই এখন পর্যন্ত পাঠক আছি। পাঠক থেকে প্রথম আলো সিলেটের পরিবেশক (এজেন্ট) হিসেবে কাজ করছি। তাই প্রথম আলোকে নিয়ে আমার দুটো ভাগে মূল্যায়ন। একটি পাঠক হিসেবে, অন্যটি ব্যবসায়িক।
শুরুতে পাঠক হিসেবে বলছি। প্রথম আলো শুধু একটি পত্রিকা নয়, বহুমুখী কাজের জন্য সেরা। যেমন অ্যসিড সন্ত্রাসবিরোধী ও মাদকবিরোধী উদ্যোগ, বন্যার্তদের সহায়তা ইত্যাদি। একটি পত্রিকা যে সমাজকল্যাণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, এটি প্রথম আলো দেখিয়ে দিয়েছে। গরিব মেধাবীদের পাশাপাশি হকার শ্রেণির পাশেও থাকে প্রথম আলো। হকারদের সন্তানদের বৃত্তি ও বিপদআপদে সহায়তা প্রথম আলোর প্রতি পাঠকের আস্থা আরও বাড়িয়ে দেয়। রাজনৈতিক খবর পরিবেশনায় বস্তুনিষ্ঠতা এক কথায় পাঠকনন্দিত। আমি শুরু থেকে দেখে আসছি, দলনিরপেক্ষ চরিত্রটি দিন দিন আরও বিকশিত করেছে প্রথম আলো।
এবার আসি ব্যবসায়িক দিক নিয়ে। করোনা পরিস্থিতিতে প্রথম দফা লকডাউনে সিলেটে একটানা আড়াই মাস পত্রিকা আসেনি। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে যখন পত্রিকা এল, তখন আমাদের সামনে সম্পূর্ণ নতুন এক বাস্তবতা দেখা দেয়। পাঠকের অভ্যাস বদল হয়। পত্রিকার পাঠক সংখ্যা সংগত কারণে কমে যায়। সাধারণত পত্রিকা বেশি পড়েন মধ্যবিত্তরা। ইন্টারেনট ব্যবহার, মুঠোফোনে খবরাখবর দেখার সহজলভ্যতায় ছাপা পত্রিকার চাহিদা কমে যায়। জীবনযাপনের ব্যয়ভার কমাতে গিয়ে অনেকে পত্রিকার গ্রাহক হওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ অবস্থায় ভ্রাম্যমাণ হকার বিক্রেতারা পেশা বদল করেন। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে আমরা যখন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছি, তখন পাঠকের অভ্যাস পরিবর্তনে পত্রিকা বিক্রির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তার মানে প্রথম আলো পড়ছেন না, বা পড়া ছেড়ে দিয়েছেন এমন কিন্তু নয়। পত্রিকা তাঁরা ইন্টারনেটে পড়ছেন। এ জন্য মাঠের হকার সংখ্যা কমে গেছে। এই বাস্তবতায় ছাপা পত্রিকা আগের জায়গা ফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, প্রথম আলো সব দিক চিন্তাভাবনায় রেখেছে, সর্বাত্মক সচেষ্ট থেকে এই অবস্থা মোকাবিলা করছে। ধীরে ধীরে বিক্রিও বাড়ছে। আমরাও মাঠের হকারদের পাশে টানার চেষ্টা করছি। এখনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি খোলেনি। আশা করছি, পরিস্থিতি পূর্ণ স্বাভাবিক হলে প্রথম আলো আগের জায়গায় ফিরবে।
মো. তসলিম উদ্দীন
পত্রিকা বিক্রেতা, রাজশাহী
সময়টা ১৯৮১ সাল। মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। কাজের খোঁজে বেরুতে হয় আমাকে। কাজ পাওয়াটা খুব দুরূহ ছিল। তবু পেয়ে গেলাম। সংবাদপত্র হকার হিসেবে কাজ শুরু করলাম ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর। কর্মজীবন শুরু হয় নিউজ পেপার এজেন্ট মো. হেকমত উল্লাহর কাছে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে। সেই থেকে শুরু আর থামিনি। এখন আমি শহরের জ্যেষ্ঠ হকারদের একজন।
সংবাদপত্র জগতে হকারদের কাজে গতি এনে দেয় প্রথম আলো। ১৯৯৮ সালের নভেম্বর থেকেই প্রথম আলোর সঙ্গে পথচলা। প্রথম আলো যেভাবে হকারদের জীবন পাল্টে দিয়েছে, তা ভোলার নয়।
আশির দশকে সংবাদপত্র আসতে এক-দুদিন পর পর। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। সংবাদপত্রের দাম ছিল মাত্র ৮০ পয়সা। পাঠক ছিল হাতে গোনা। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বাজারে একটি নতুন পত্রিকা আসার খবর পাই পত্রিকার বিজ্ঞাপনে। পত্রিকাটির নাম প্রথম আলো। এই পত্রিকার মেকআপ দেখেই মন ভালো হয়ে যায়। মানুষও আগ্রহ দেখিয়ে কেনা শুরু করে।
অন্য সব পত্রিকা বলে–কয়ে বিক্রি করলেও প্রথম আলো পাঠকই খুঁজে নিতেন। তর তর করে রাজশাহীতে চাহিদা বাড়তে থাকে। আমাদের কপাল খুলতে শুরু করল। হকার জীবনে একটু স্বচ্ছলতা আসা শুরু ঠিক তখন থেকেই। প্রথম আলোর সঙ্গে ২৩ বছরের এই সম্পর্ক কখনো ভোলার নয়।
বাংলাদেশে প্রথম আলোই অনেক নতুন নতুন পাঠক তৈরি করেছে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় বড় দুর্নীতির খবর প্রথম আলো তুলে এনেছে। সৃষ্টিশীল নানা কাজের সঙ্গে প্রথম আলো থাকায় হকারদের পাঠক পেতে খুব কষ্ট হয়নি।
করোনার সময়ে অনেকে মনে করেছিল ছাপা পত্রিকার দিন শেষ। কিন্তু সেই অবস্থা এখন পাল্টে যাচ্ছে। রাজশাহীতে প্রথম আলোর পাঠকেরা আবার প্রথম আলোতে ভরসা রাখছেন।
সংবাদপত্র বিক্রির কাজ করে আধাপাকা বাড়ি করেছি। দুই মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে নার্সিং পেশায় কর্মজীবন শুরু করেছে। তাঁরা দুজনই এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। সে জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সংবাদপত্র বিলি করে উপাজির্ত অর্থে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছি। ছেলে প্রথম আলো থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছে। এ জন্য প্রথম আলোর সম্পাদকসহ প্রথম আলো পরিবারের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সোহবান সরদার
পত্রিকা বিক্রেতা, যশোর
আমি তখন যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া এলাকার মাহমুদুর রহমান বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। ক্লাস চলছিল। কয়েকজন এসে বলল, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, তোমরা বাড়িতে চলে যাও। আপাতত স্কুলে এসো না।’ এরপর আর লেখাপড়া করা হয়নি।
শহরের দড়াটানা মোড়ে ইয়াকুব আলীর পত্রিকা বিক্রির দোকান ছিল। পাকিস্তান ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকার এজেন্ট ছিলেন তিনি। তিনিই আমাকে পত্রিকা বিক্রির কাজে লাগিয়ে দিলেন। সেই থেকে আজ অবধি ৫০ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করেই যাচ্ছি।
প্রথম আলো বাজারে আসার প্রথম দিন থেকেই এই পত্রিকার সঙ্গেই আছি। পত্রিকাটি আমাদের হকারদের কাজে গতি এনে দিয়েছে।
প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি সম্পাদকসহ সবাইকে অভিনন্দন জানাই এবং প্রথম আলোর অগ্রগতি ও সাফল্য কামনা করছি।
যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে দুই শ থেকে তিন শ গজ দূরে ঘোপ সেন্ট্রাল সড়কে কবরস্থানের পাশে আমার বাড়ি। পৈতৃক পাঁচ কাঠা জমিতে মা, স্ত্রী, তিন ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে আমার বসবাস।
বিএ (স্নাতক) পাস করিয়ে মেয়েকে ইতিমধ্যে বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলেকেও বিয়ে দিয়েছি। তারা ব্যবসা করে।
ছোট ছেলে এখনো কাজ খুঁজছে। পত্রিকা বিক্রি করে প্রতিদিন যে টাকা রোজগার হয়, তাতেই মোটামুটি ভালোভাবেই আমার সংসার চলে যায়।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পাকিস্তান, আজাদ, মর্নিং নিউজ, অবজারভার এবং একটি উর্দু ভাষার পত্রিকা ও পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত আরও দুটি উর্দু ভাষার পত্রিকা বিমানে করে যশোরে আসত। আমরা সেই পত্রিকা বিক্রি করতাম। এখন জাতীয় ও স্থানীয় মিলিয়ে প্রতিদিন ১৩৫টি পত্রিকা বিক্রি করি। এর মধ্যে ১১৮টি জাতীয় পত্রিকা।
প্রতিদিন সকালে পান্তা খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। সারা দিন টার্মিনালে পত্রিকা বিক্রি করি।
দুপুরে টার্মিনালের হোটেলে হালকা কিছু খেয়ে নিই। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি এই পত্রিকার আরও সাফল্য কামনা করি।
মাহমুদুল হাসান
স্বত্বাধিকারী, ফরিদপুর
আমার বাবা ছিলেন পত্রিকার এজেন্ট। ফলে আমার বাল্য ও শৈশব কেটেছে পত্রিকার মধ্যে। ৫০ বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর আমাকেই
এই ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হয়।
আমি সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি। এরপর ফরিদপুরে ফিরে পৈতৃক ব্যবসা পত্রিকার এজেন্সির কাজকেই প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করি। প্রায় ৫০ বছর ধরে ওতপ্রোতভাবে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চোখের সামনে অনেক পত্রিকাকে জন্ম হতে দেখেছি, আবার চোখের সামনেই বন্ধ হয়ে যেতেও দেখেছি।
যে পত্রিকাগুলো ফরিদপুরে প্রতিদিন আসে, তার মধ্যে বহুল বিক্রি হওয়া পত্রিকা হলো প্রথম আলো। আমি প্রথম আলোর একজন নিয়মিত পাঠকও বটে। মাঝেমধ্যে ভাবি, প্রথম আলোর এত পাঠকপ্রিয়তার কারণ কী। আমার উপলব্ধি এবং পাঠকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, প্রথম আলো সত্য প্রকাশ করে, এটাই তার মূল শক্তি।
পাশাপাশি দায়িত্বের ব্যাপারে দারুণ সজাগ। যেকোনো ঘটনার খবর অন্যান্য পত্রিকায় পড়ার পরও পাঠক সঠিক তথ্য জানার জন্য প্রথম আলোকেই বেছে নেয়। তা ছাড়া তরুণ প্রজন্মের রুচি মাথায় রেখে পত্রিকাটি যেভাবে প্রতিবেদন, ফিচার ও মতামত প্রকাশ করে, তা সব সময় প্রশংসিত হয়েছে।
এই পত্রিকাটির অনুসন্ধানী ও সৃজনশীল সাংবাদিকতা পাঠকের কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের। এ কারণেই প্রথম আলো শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে পাঠকপ্রিয়।
পাঠক পত্রিকার স্টলে এসে অনেক পত্রিকা নাড়াচাড়া করলেও শেষ পর্যন্ত বাড়িতে নিয়ে যান প্রথম আলো। প্রথম আলো ২৩ বছর পর করেছে। প্রথম আলোর সঙ্গে থাকতে পেরে আমিও গর্বিত।
প্রথম আলোর অতিথি হয়ে আমার একবার কক্সবাজার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ওই সময় প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি এই পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানসহ সবাইকে অভিনন্দন জানাই। অগণিত পাঠকদের জানাই কৃতজ্ঞতা।