>• উয়ারী-বটেশ্বর
• মামলা, নকশা-সংক্রান্ত জটিলতা প্রভৃতি কারণে গত ছয় বছরেও শুরু হয়নি ‘গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর’ তৈরির কাজ
উয়ারী ও বটেশ্বরে খনন করে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয় অর্ধ যুগেরও আগে। এ লক্ষ্যে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বটেশ্বর গ্রামে জাদুঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য ২০১৩ সালে অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু গ্রামবাসীর মামলা, নকশা-সংক্রান্ত জটিলতা প্রভৃতি কারণে গত ছয় বছরেও শুরু হয়নি ‘গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর’ তৈরির কাজ। ফলে দর্শনার্থীরা এসে এসব প্রত্নবস্তু না দেখতে পেরে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন লেখক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। তিনি বলেন, ‘আমি জীবদ্দশায় এই জাদুঘর দেখে যেতে পারব কি না জানি না। জাদুঘরটি হলে আমার ব্যক্তিগত লাভের তো কিছু নেই, বরং জাদুঘর না থাকলে পুরো জাতির ক্ষতি হবে।’
উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া দুর্লভ সব নিদর্শন প্রদর্শনের জন্য তিনতলা জাদুঘর ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৭ কোটি ৮৭ লাখ ৩৮ হাজার ৩০৬ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণের নামে ওই অর্থ বরাদ্দ দেন। এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা পরিষদকে। জাদুঘর নির্মাণের জন্য বটেশ্বর গ্রামে তিনটি প্লটে চার বিঘা দুই কাঠা জমি বাছাই করে ঐতিহ্য অন্বেষণ। এই জমি স্থানীয় সাতজনের কাছ থেকে প্রায় ৭৫ লাখ টাকায় কিনে নিয়ে তা ঐতিহ্য অন্বেষণের নামে দান করেন শিল্পপতি আবদুল কাদির মোল্লা।
দুই গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাদুঘরের জন্য জমি বাছাই হওয়ার পর উয়ারী গ্রামের লোকজনও জমি দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। জাদুঘরটি উয়ারীতে নির্মাণের দাবিতে ওই গ্রামের ১৫ ব্যক্তি মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান ও সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নামে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। দুই বছর পর ২০১৭ সালে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়।
নরসিংদী জেলা পরিষদ থেকে জানা গেছে, জমি বাছাই হওয়ার পর নকশা তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১৫ সালের নভেম্বরে। স্থপতির কাছ থেকে নকশা পাওয়ার পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) পাঠানো হয়। প্রত্যাশা ও বরাদ্দের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে ওই স্থপতি পাঁচবার নকশা সংশোধন করেন। এটা করতে গিয়ে আড়াই বছর সময় নষ্ট হয়। এ ছাড়া জাদুঘরের জন্য স্থান নির্বাচন নিয়ে দুই গ্রামবাসীর দ্বন্দ্ব ও আদালতে মামলা চলমান থাকায় আরও সময়ক্ষেপণ হয়। সব সমস্যা সমাধানের পর দুই মাস আগে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে জেলা পরিষদ। এখন দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে।
পাটুলি গ্রামের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আমির হোসেন বলেন, ‘পর্যটকেরা আসতে শুরু করলে বেলাব উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে। আশা করি, এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেবে কর্তৃপক্ষ।’
ঐতিহ্য অন্বেষণ জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত উয়ারী-বটেশ্বরে ছিল আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ। এখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ২০০০ সাল থেকে খননকাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৫০টি স্থান থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রৌপ্যমুদ্রা, উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র, ধাতব নিদর্শন প্রভৃতি।
ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উয়ারী-বটেশ্বরের কামরাব এলাকার বৌদ্ধ পদ্মমন্দির ও টঙ্গীর টেকের বৌদ্ধমন্দির বাদে অন্য প্রত্নস্থানগুলো খননের পর তা মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সংরক্ষণের স্থায়ী ব্যবস্থা ছাড়া এসব প্রত্নসামগ্রী প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা কঠিন। এখানকার আবিষ্কৃত প্রত্নস্থাপনা ও প্রত্নসম্পদের ব্যাখ্যাসহ ছবি, প্রত্নবস্তুর মডেল, রেপ্লিকা (প্রতিরূপ), প্রত্নবস্তু, প্রত্নবস্তুর আলোকচিত্র, বিবরণ ও বিশ্লেষণ প্রদর্শন করা হবে গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘরে। তখন আর দর্শনার্থীদের হতাশ হতে হবে না।
উয়ারী গ্রামে জাদুঘর নির্মাণ না করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুরো উয়ারী গ্রামের মাটির নিচে প্রত্নবস্তু ছড়িয়ে রয়েছে। তাই ওই গ্রামে জাদুঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় সাংসদ ও শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, দ্রুত গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘরের নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে। কী কারণে এত দেরি হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নেবেন।