পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা।
জাতির পিতার স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব বর্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা আলো জ্বালতে পারলাম এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। আমরা আলোকিত করেছি, এ দেশের প্রত্যেকটি মানুষের ঘরকে।’
গতকাল সোমবার পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন ছাড়াও দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম শতভাগ বিদ্যুতায়নের দেশ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারল।
ওয়াদা অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ঘর আলোকিত করা হয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই দিন আলোর পথে যাত্রার সফলতার সেই দিন। তিনি বলেন, দেশের কোনো ঘর অন্ধকারে থাকবে না। প্রতিটি মানুষের জীবন আলোকিত হবে, তারা উন্নত জীবন পাবে, সুন্দর জীবন পাবে। এটিই তাঁর সরকারের লক্ষ্য। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব বর্ষে দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না, আশ্রয়হীন থাকবে না। সেটাও তাঁর সরকার করে ফেলবে, ইনশা আল্লাহ।
দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব কাজ সবাই মিলে এক হয়ে করতে হবে। যাতে বাংলাদেশ আর পিছিয়ে যেতে না পারে। অন্ধকারে ফিরে যেতে না পারে। স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীরা আর যেন মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে।
টানা তিন মেয়াদে দেশের মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ থেকে ২০২২—এই ১৩ বছর ভোট দিয়ে বাংলার মানুষ ক্ষমতায় রেখেছে। সেই কারণেই বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারছে। সেই এগিয়ে যাওয়ার পথেও অনেক বাধাবিপত্তি ছিল। বাধাবিপত্তি অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে বলেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র অবহেলিত দক্ষিণবঙ্গের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, অবহেলিত বরগুনা, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণবঙ্গ ঝড়-ঝঞ্ঝায় অবরুদ্ধ ছিল। মানুষকে কষ্ট-দুর্ভোগে পড়তে হতো। আর সেটা হবে না। এই দক্ষিণবঙ্গের মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ পাবে। তাদের জীবনও আলোকিত হবে, সুন্দর হবে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে সপরিবার জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং এরপর ছোট বোন শেখ রেহানাসহ শরণার্থী জীবনযাপনের কথা তুলে ধরতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি হারিয়েছি আপনজন। কিন্তু ফিরে পেয়েছি বাংলার জনগণকে, তাদের ভালোবাসা। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের, যাঁরা আমার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস দেখিয়েছেন।’
পঁচাত্তর–পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ এগিয়ে যায়। কিন্তু পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশ বারবার পিছিয়ে গেছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬—এই ২১ বছর এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছর বাংলাদেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। তিনি বলেন, পঁচাত্তরের পর স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীরা জয় বাংলা স্লোগানকে নিষিদ্ধ করেছিল। সেই জয় বাংলা স্লোগান ফিরে এসেছে। তারা জাতির পিতার নামটাও মুছে ফেলতে চেয়েছিল। ইনশা আল্লাহ আর কেউ এই নামটা মুছে ফেলতে পারবে না। জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। কেউ এই অগ্রগতি রুখতে পারবে না।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ও চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম। আরও বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান এবং ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। অনুষ্ঠানে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতির ওপর ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়।
মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনসহ স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা এবং বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসানসহ ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
করোনা মহামারি শুরুর পর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাইরে দেশের অন্য কোথাও এটিই ছিল সশরীর প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর। এ সফরকে কেন্দ্র করে পটুয়াখালীসহ আশপাশের এলাকায় ছিল উৎসবের আমেজ। প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করে নিতে নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনও সবার নজর কেড়েছে। ১ হাজার একর জায়গায় গড়ে তোলা পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকা ছাড়াও আশপাশের সব সড়ক রংবেরঙের বেলুন, বিলবোর্ড ও ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ব্যানার-ফেস্টুন ও তোরণ স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়েছেন।
গতকাল বেলা পৌনে ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র–সংলগ্ন হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। সেখানে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন তিনি। পরে বিদ্যুৎকেন্দ্র–সংলগ্ন কোল জেটিতে রঙিন পালতোলা ২০০ নৌকা থেকে পতাকা নাড়িয়ে এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানানো হয়। এরপর সর্বাধুনিক আলট্রা–সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেন শেখ হাসিনা। পরে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তিনি। এ সময় বেলুন ও ১ হাজার ৩২০টি পায়রা ওড়ানো হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন এবং দেশের শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। বেলা দুইটায় হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় ফিরে যান প্রধানমন্ত্রী।