যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে ফাঁদে ফেলেনি, তারাও এখন ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা ঝামেলার মুখে পড়ছে। অবশ্য বিক্রি কমেনি বলে দাবি।
দেশের কিছু কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ‘প্রতারণার’ কারণে দুর্নামের মুখে পড়েছে এ খাতের সব প্রতিষ্ঠান। যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহককে বিপুল ছাড়ের লোভ দেখায়নি, পাওনা আটকে রাখেনি, তাদেরও এখন কিছু কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, সার্বিকভাবে তাদের পণ্য বিক্রি কমেনি। ব্যবসার প্রবৃদ্ধিও আগের মতোই আছে।
প্রতারণা ও অর্থ পাচার নিয়ে মামলায় এখন ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম, ধামাকা, টোয়েন্টিফোরটিকিট ডটকম, নিরাপদডটকম, এসপিসিওয়ার্ল্ড ও থলে—এই আট প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মকর্তা কারাগারে। কার্যালয় বন্ধ করে লাপাত্তা আনন্দের বাজার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছে, তারা মোট ৩০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে রেখেছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠান বিপুল ছাড় দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণ করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা ক্রেতার টাকা ফেরত দিতে পারছে না। কেউ কেউ গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার দায়েও অভিযুক্ত। এর বিপরীতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান আগের মতোই সাধারণ ব্যবসায়িক কৌশলে ব্যবসা করেছে। তারা এখনো ‘ভালো’ ব্যবসা করছে। কিন্তু ব্যবসার ঝক্কি বেড়েছে। যেমন একটি প্রতিষ্ঠান বলছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখন নিয়মিত তাদের ডেকে নিচ্ছে। বিপণনকৌশল সম্পর্কে জানতে চাইছে, যা তারা ফাঁস হতে দিতে রাজি নয়।
অবশ্য শিগগিরই এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা চাইছেন, ই-কমার্স খাতে প্রতারণা ও সন্দেহজনক ব্যবসার অবসান হোক। সরকার ক্রেতাবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা তৈরি করুক, যাতে এ খাত সম্ভাবনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারে।
বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষও মনে করেন ই-কমার্স দেশের উদীয়মান খাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল ই-কমার্স খাতের জন্য প্রয়োজনীয় আরও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যারা ভালো, তারা যাতে আরও ভালো করতে পারে, সেটাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চাওয়া। তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে নীতিমালা, বিদেশি বিনিয়োগ আনার স্বার্থে ২০২০ সালে নীতিমালা সংশোধন এবং এ বছরের জুলাইয়ে পরিচালনা নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে খাতটির স্বার্থেই। গুটিকয় প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো খাত প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। তবে তা একেবারেই সীমিত পরিসরে ছিল। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে অনলাইনে অর্থ পরিশোধ পদ্ধতি চালু করে। ২০১৩ সালে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। একই বছর দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (থ্রি-জি) চালু করে। সব মিলিয়ে ২০১৩ সালের পর ই-কমার্স খাত গতি পেতে শুরু করে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্য এখন দেড় হাজারের বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের তালিকায় আছে এক হাজার প্রতিষ্ঠানের নাম।
গবেষণা সংস্থা লাইটক্যাসল পার্টনার্সের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার দাঁড়াবে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। অথচ পাঁচ বছর আগেও, অর্থাৎ ২০১৬ সালে দেশের এ খাতের বাজারটি ছিল ৫৬০ কোটি টাকার। এ খাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেবসুকভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে ই-কমার্স খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষের।
ই-কমার্স খাতের প্রসার বেশি হয় করোনাকালে। এ সময় সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা শুরু করে। এতে বড় ক্রেতাশ্রেণি তৈরি হয়। এখন বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
এই খাত ভাবমূর্তিসংকটে পড়ে চলতি বছরের মাঝামাঝি এসে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৬ জুন এক প্রতিবেদনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়, আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির যে সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে ১৬ শতাংশ গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ সম্ভব। এরপর একে একে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ ও কিউকমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মালিক ও কর্মকর্তারা ধরা পড়েন। এতে ভাবমূর্তিসংকটে পড়েছে অন্যরাও।
দেশের ই-কমার্স খাতের বাজার হিস্যায় সবচেয়ে এগিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান আলিবাবার মালিকানায় থাকা দারাজ। ২০১৮ সালে দারাজকে কিনে নেয় আলিবাবা। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা এখন দিনে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছে দেয়। তবে বিশেষ কোনো বিপণন কর্মসূচি চলাকালে তা ৩ লাখে উঠে যায়।
দারাজের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাঁদের ব্যবসার প্রবৃদ্ধিতে কোনো প্রভাব ফেলেনি। ব্যবসার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল।
বাজার হিস্যার দিক দিয়ে দারাজের পর রয়েছে ফুড পান্ডা, চালডাল, অথবাডটকম, পিকাবু, আজকের ডিল, বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রকমারিডটকমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। পিকাবুর প্রধান নির্বাহী মরিন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, মুঠোফোনের ওপর ৮ থেকে ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া যায়। কিন্তু গত দুই বছরে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বা তারও বেশি ছাড়ের প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। ই-কমার্স মানেই বড় ছাড়ে পণ্য—এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। তিনি বলেন, ই-কমার্স খাতের সম্ভাবনা এখনো অনেক। শুধুই ছাড়ে পণ্য কিনতে চাওয়া গ্রাহকেরা সাধারণত নিয়মিত গ্রাহক হতে পারেন না।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অথবাডটকম যাত্রা শুরু করে ২০১৫ সালের নভেম্বরে। অথবাডটকমের ব্যবসা বিভাগের প্রধান নূর মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারণে মানুষের মধ্যে এ খাত নিয়ে কিছুটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তবে যারা দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে, তাদের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বেড়েছে।
ই-কমার্স খাতে প্রতারণার ঘটনাগুলো বেরিয়ে আসার পর কী কী সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা মোটাদাগে চারটি সমস্যার কথা বলছেন:
১. বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছানোর পর টাকা পরিশোধ নিশ্চিতে যে ‘এসক্রো’ ব্যবস্থা চালু করেছে, তাতে প্রতিষ্ঠানের টাকা আটকে থাকছে। কারণ, ‘এসক্রো’র মাধ্যমে টাকা পেতে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগছে। ক্রেতা পণ্য পেয়েছেন কি না, তা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয় জনবল ‘এসক্রো’ সেবাদাতাদের নেই।
২. নগদ টাকা পরিশোধ (ক্যাশ অন ডেলিভারি) করে পণ্য নেওয়ার হার বেড়েছে। এতে পণ্য পৌঁছে দিতে যাওয়া ব্যক্তিকে প্রচুর নগদ অর্থ বহন করতে হচ্ছে। এটা ব্যবসার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। আবার ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ বাড়লে পণ্য ফেরতের হার কিছুটা বেড়ে যায়।
৩. নতুন নতুন উদ্ভাবনী ব্যবসা কৌশল নিতে অনুমোদনের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। নতুন নতুন নিয়মকানুন আসছে, কিছু ক্ষেত্রে যা ব্যবসায় বাধা তৈরি করছে।
৪. প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পণ্য সরবরাহকারীদের বিপুল টাকা আটকে আছে। তাঁরা নতুন পণ্য কিনতে পারছেন না। এসব প্রতিষ্ঠান অন্যদেরও সরবরাহকারী। ফলে পুরো বাজারে সরবরাহকারী বা ভেন্ডরের অভাব দেখা যাচ্ছে।
এর বাইরে নতুন গ্রাহক তৈরির ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানান চালডালের হেড অব গ্রোথ ওমর শরীফ। তিনি বলেন, নতুন গ্রাহকেরা আস্থার সংকটে ভুগছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে অনীহাও প্রকাশ করছে। তাই গ্রাহক ধরে রাখতে ছাড় নয়, সেবার মানে নজর দিতে হবে।
ই-কমার্স মাধ্যমে ব্যবসা করার জন্য দেশে কোনো লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ নেই। এমনকি ই-কমার্স আইনও নেই দেশে। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন এবং সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আইন ও কর্তৃপক্ষ করা যায় কি না, তা নিয়ে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, খাতের জন্য নীতিমালা দরকার। তবে তা যেমন গ্রাহকবান্ধব হতে হবে, তেমনি হতে হবে ব্যবসাবান্ধবও। খাতটি কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তাই এমন কোনো অবাস্তব নীতিমালা হওয়া উচিত নয়, যা খাতের অগ্রগতিকে বাধার মুখে ফেলে। তারা আরও বলছে, নীতিমালা করার ক্ষেত্রে এ খাতে ব্যবসারত প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত নিতে হবে। যাদের ব্যবসা নেই বললেই চলে, তাদের নিয়ে নীতিমালা করলে খাতের জন্য ভালো হবে না।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকেরডিলডটকমের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, যে সংকট তৈরি হয়েছে তা কাটাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, যারা এই খাতে ভালো কাজ করছে, তাদের যদি নীতিগত সমর্থন দেওয়া যায়, তাহলে তারা নতুন গ্রাহকদের ই-কমার্সে আগ্রহী করতে ভূমিকা রাখতে পারবে।