প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার সহকারী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান ওরফে সেলিম যে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, বিষয়টি অনেকে জানতেন। তবে কখনো আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আনিছুর গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিষয়টি এখন আলোচনায় এসেছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, 'আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা মঙ্গলবার জানিয়েছেন, অনেক সময় আনিছুর বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে চিঠি দিতেন। বিষয়টি জানিয়ে প্রকৌশলী দেলোয়ার আমাদের হেড অফিসে চিঠিও দিয়েছিলেন। দেলোয়ারের চিঠির পর আনিছুর রহমান তাঁর চিঠি প্রত্যাহার করেন। বাস্তবে এমন চিঠি দেওয়ার ক্ষমতা আনিছুরের নেই। এ নিয়ে দেলোয়ার এবং আনিছুরের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়েছিল। আনিছুর টঙ্গীতে দায়িত্ব পালন করার সময়ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফাপর দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আদায় করেছেন।'
মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে যে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেটা শতভাগ নিশ্চিত। তবে কেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই বলে জানান মেয়র। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে পুলিশ। হত্যার কারণ সম্পর্কে পুলিশ ভালো বলতে পারবে।
দেলোয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল প্রথম আলোকে বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেলোয়ার হোসেন হত্যা মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। দেলোয়ারের সহকর্মী প্রকৌশলী আনিছুর রহমানকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
দেলোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডে কতজন জড়িত বা কেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে? এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিসি নাবিদ কামাল বলেন, দেলোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডটি একটি আলোচিত মামলা। তদন্ত শেষ হলে সব তথ্য মানুষকে জানানো হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মঙ্গলবার এক বিৃবতিতে বলছেন, 'গণমাধ্যম ও অন্যান্য নির্ভরযাগ্য তথ্যমতে, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত স্থানীয় অবকাঠামো সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি ও নির্মাণ-প্রকৌশল খাতে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে নির্বাহী প্রকৗশলী দেলোয়ার হোসেনের সাহসী ও কঠোর দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে দুর্নীতিবাজ সহকর্মী ও স্বার্থান্বেষী প্রভাবশালী দোসরদের বিরাগভাজন হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে।'
মেয়রের কাছে তদবিরও করেছিলেন আনিছুর
দেলোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার সহকারী প্রকৌশলী আনিছুর রহমান কোনাপাড়ার দায়িত্ব পাওয়ার জন্য অন্য লোক দিয়ে তদবিরও করিয়েছিলেন বলে জানান মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
মেয়র জাহাঙ্গীর বলেন, 'কোনাপাড়ায় আনিছুর রহমান তাঁকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য দুই-তিনটা তদবিরও করিয়েছিলেন। আমি কিন্তু আনিছুরকে কোনো দায়িত্ব দিইনি। দেলোয়ারকে কোনাপাড়ায় দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকে আনিছুর রহমান তদবির করান। আমি আনিছুরকে বলেছি, তোমার যেটা কাজ, সেটা তুমি করো। কাজের তদারকির জন্য আমি নিজস্বভাবে দুইটা টিম রেখেছি। যাঁরা চাইনিজদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁরা সরেজমিন দেখে আমাকে রিপোর্ট দেন। একদিন তাঁরা আমাকে বলেন, “কোনাবাড়িতে একটা রোডে বালু কম দিয়েছে।” তখন আমি আনিছুরকে ফোন দিই। বললাম, রোডে কাজ কম হলো কেন? কারণ কী? তখন আনিছুর বলেন, “স্যার অসুবিধা নেই।”'
আনিছুর সুবিধার লোক নয় বলে দাবি করে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ' কোনাবাড়ি এলাকায় মাঠপর্যায়ের কাজ দেখে আমার লোকজন এসে বলল, “স্যার, প্রকৌশলী আনিছুর তো লোক সুবিধের না। মিছা কথা কয়। যা কিছু কাজ আনিছুর থেকেই তো সব করায়।” আমি আনিছুরকে ফোন দিই। আমি বলি, আনিছর তোমার কথা কাজে কিন্তু কোনো মিল নেই। যদি আরেকবার হয়, তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে পানিশমেন্টে নেব।'
নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে কখনো ওএসডি করা হয়নি জানিয়ে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, 'বলা হচ্ছে, দেলোয়ারকে ওসডি করা হয়েছিল, এটা কিন্তু একটা ভুল মেসেজ। তাঁকে হেড অফিসে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমি তাঁকে হেড অফিসে নিয়ে এসেছি। আমাদের দেশে কাজ করার সময় ইঞ্জিনিয়াররা কিন্তু অনেক সময় রাস্তায় যান না। আমি সব সময় চেষ্টা করি রাস্তায় যাওয়ার। কাশিমপুর জেলখানার একটা রোডের ঢালাই কাজের সময় আমি পররপর তিন দিন যাই। কিন্তু একদিনও সেখানে প্রকৌশলী দেলোয়ার আসেননি। তখন আমি দেলোয়ারকে ফোন দিই। আমি বললাম, মেয়র হিসেবে আমি তিন দিন আসলাম। আপনি (দেলোয়ার) একদিনও আসলেন না। এটা কী ঠিক হলো? তখন দেলোয়ারসহ মাঠপর্যায়ে সেখানে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের হেড অফিসে নিয়ে আসা হয়। পরে প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হেড অফিসে কোনাবাড়ির অনেক শিডিউল বানান। পরে আবার তাঁকে আমি কোনাবাড়ির দায়িত্বে দিই। তখন দেলোয়ার হোসেন আমার কাছে লিখিত দেন। সেখানে তিনি বলেন, তাঁর ভুল হয়ে গিয়েছিল তখন। এমন ওই ভুল আর হবে না।'
দেলোয়ারের বিল আটকে দেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে দাবি করেন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘দেলোয়ার তো ওখানে চিফ না। দেলোয়ারের পরে আরও চারজন আছে। দেলোয়ার যদি একটা বিল দেন, তাহলে হবে এমন কিন্তু না। দেলোয়ার কিন্তু সেই লেভেলের অফিসার না।’ সেলিমের সঙ্গে প্রায় দেলোয়ারের কথা–কাটাকাটি হতো বলে জানান মেয়র জাহাঙ্গীর।
টিআইবি বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় এ ঘটনায় সরাসরি জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত এবং গ্রেপ্তারে আশাবাদ তৈরি করলেও নেপথ্যের রাঘববোয়াল কাউকেই এখনো আইনের আওতায় আনা যায়নি। ঠিকাদারি কাজের নিম্নমান, বাজারদরের চেয়ে বেশি মূল্য দেখিয়ে বিল তৈরিসহ বেশ কিছু বিষয়ে দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে অসাধু ঠিকাদারদের একাংশের বিরোধের সূত্রপাত। যা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের শীর্ষ কর্তৃপক্ষও অবহিত ছিল বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন কী পদক্ষেপ নিয়েছিল বা আদৌ নিয়েছিল কি না? নিয়ে থাকলে সেটি কী? যেসব কাজ ও ঠিকাদারের দুর্নীতির বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছিল, সেসব বিষয়ে সিটি করপোরেশনের অবস্থান কী, তা জনসমক্ষে আসা উচিত বলে মনে করে টিআইবি। এ ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এ ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।
টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন সঠিক সময়ে এসব দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা ও কঠোর অবস্থান নিলে এমন দুঃখজনক পরিণতি দেখতে হতো না। সৎ থাকার পুরস্কার ও পর্যাপ্ত সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার পরিবর্তে এরূপ নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হতো না একজন নিষ্ঠাবান প্রকৌশলীকে। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটি নিজের কর্মীকে দুর্নীতিবাজদের থাবা থেকে রক্ষা করতেই শুধু ব্যর্থ হয়নি, বরং দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি অঙ্গীকারকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।'
১৩ মে দেলোয়ার হোসেনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১১ মে মিরপুরের বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় ভাড়া করা মাইক্রোবাসে নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাঁর সহকর্মী আনিছুর রহমান ও তাঁর দুই সহযোগী শাহিন ও হাবিব ছিলেন। হাবিব মাইক্রোবাস চালাচ্ছিলেন। মাইক্রোবাসটি রূপনগর দিয়ে বেড়িবাঁধে ওঠার পর আনিছুর রহমানের ইশারায় শাহিন প্রকৗশলী দেলোয়ারের গলায় রশি পেঁচিয়ে টান দেন। তখন আনিছুরও চেপে ধরেন দেলোয়ারকে। এরপর দেলোয়ার নিস্তেজ হয়ে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাকে পেটানো হয়। পরে দেলোয়ারের লাশ উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরের খালি প্লটে ফেলে দেওয়া হয়। দেলোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার ভাড়াটে খুনি শাহিন ও হাবিব আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তাঁরা বলেছেন, আনিছুর খুনের জন্য তাঁদের ভাড়া করেন। ঘটনার সময় আনিছুরও গাড়িতে ছিলেন এবং তার নির্দেশেই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।