পাতা ঝরার দিন শেষ। এখন সময় ঋতুরাজ বসন্তের। তার ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে প্রকৃতি। গাছের কচিপাতায় আলোর নাচন। ফুটেছে নানা রঙের ফুল। কিন্তু প্রকৃতির এই নবজাগরণ স্পর্শ করেনি পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত বাংলোর এক পাশের গাছটিকে। যেকোনো দিন বাতাসে উপড়ে যেতে পারে ‘মৃত’ গাছটি।
আর পাশে বসে এই গাছেরই ‘গভীর দুঃখ’ রং-তুলির স্পর্শে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুস। এক ফাঁকে আলাপ জমে ওঠে। বললেন, ‘ঢাকায় উন্মুক্ত পরিবেশে ছবি আঁকার সুযোগ তেমন পাওয়া যায় না। সে কারণে এখানে আসা। প্রকৃতিতে সবাই শুধু সবুজ খোঁজে। কিন্তু মরা গাছেরও যে রং আছে তা অনেকেই দেখতে পায় না। ভাঙা ও পুরোনো দেয়ালেরও একসময় জীবন ছিল। এসবের ভেতরে যে সৌন্দর্য আর গল্প, তাই রং-তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে চাই।’
চট্টগ্রাম নগরের বাদশা মিঞা সড়কে অবস্থিত ফিনলে হিলের চূড়ায় ঢাকা-চট্টগ্রামের ১১ শিল্পীকে নিয়ে আয়োজিত আর্টক্যাম্পের চিত্র এটি। চার দিনের এই আর্টক্যাম্পের আনুষ্ঠানিকতা গতকাল শুক্রবার দুপুরে হলেও এটি শুরু হয়েছে এর আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতেই। চলবে আগামীকাল রোববার পর্যন্ত।
মোহাম্মদ ইউনুস ছাড়াও এতে যোগ দিয়েছেন শিল্পী আবুল বারক আলভী, অলোকেশ ঘোষ, আহমেদ শামসুদ্দোহা, নিসার হোসেন, শেখ আফজাল, শিশির ভট্টাচার্য, কনকচাঁপা চাকমা, দিলারা বেগম জলি, বিপাশা হায়াত ও বিশ্বজিৎ গোস্বামী।
শিল্প অনুরাগী তারেক জুয়েল, তাঁর স্ত্রী আনিকা ও কন্যা সুনেহরার উদ্যোগে ‘গ্যালারি কসমস ফাইন আর্ট স্পেস’ দ্বিতীয়বারের মতো এই ক্যাম্পের আয়োজন করে।
আর্টক্যম্পের আয়োজনস্থল ফিনলে হিলের চূড়ায় অবস্থিত তারেক জুয়েলের বাংলো বাড়িটিকে একটি ছোটখাট শিল্প সংগ্রহশালা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। বাড়ির নাম ‘স্টোরি’। বাড়িটি পুরোনো আমলের গাড়ি, বাঁশি, ক্যামেরাসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্লভ জিনিসে ঠাসা। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে দেশের বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি। চারপাশের সবুজ পরিবেশ মুহূর্তেই মন ভালো করে দেবে যে কাউকে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলতে পারেন, সে জন্য এই ক্যাম্পের আয়োজন করা হয় বলে জানান তারেক জুয়েল।
এবার প্রথম এই ক্যাম্পে অংশ নিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জায়গাটি খুব সুন্দর। সমমনা শিল্পীদের সম্মিলন ঘটেছে। ছবি আঁকা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা ও ধারণার আদান-প্রদান হচ্ছে। আড্ডা হচ্ছে। ঢাকার ব্যস্ত সময়ে তা সচরাচর সম্ভব হয় না।
ছবি আঁকার এক ফাঁকে বিরতি নেন শিল্পী নিসার হোসেন। পাশে বসে থাকা শিশির ভট্টাচার্যের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠেন তিনি। আরেক পাশে পুরোনো দিনের গান শুনতে শুনতে ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দিচ্ছিলেন শেখ আফজল। তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন আহমেদ শামসুদ্দোহা ও আবুল বারক আলভী। একপর্যায়ে যোগ দেন বিপাশা হায়াতও।
বাংলোর বারান্দায় পাশাপাশি বসে ক্যানভাসে ছবি আঁকছিলেন শিল্পী দিলারা বেগম জলি, কনকচাঁপা চাকমা ও বিপাশা হায়াত। অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত বলেন, পাহাড়ের এই শান্ত আর স্নিগ্ধ পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করেছে।
শিল্পী কনকচাঁপা চাকমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পার্বত্য জেলার রাঙামাটিতে। ঢাকায় থাকলেও তাঁর ছবিতে পাহাড়ি এলাকার জীবন ফুটে উঠে। পাহাড়ি মানুষের কঠোর পরিশ্রম, জীবনের নানা উত্থান-পতন আর অস্থিরতা তাঁর ছবিতে তুলে আনার চেষ্টা করেন এই শিল্পী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের যানজট আর ব্যস্ততায় নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। কিন্তু ছবি আঁকতে হলে শিল্পীর তো স্বস্তির প্রয়োজন। এই ক্যাম্প সে স্বস্তির কাজ করবে। এখন ঢাকায় গিয়ে আবার নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে ছবি আঁকতে পারব।’
বাংলোর একপাশে ‘মানুষ’ সিরিজের ছবি আঁকায় মগ্ন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক বিশ্বজিৎ গোস্বামী। এই ধরনের ক্যাম্প আয়োজন করায় ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক শিল্পী এসেছেন। আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। একজন অন্যজনকে বোঝার সুযোগ পাচ্ছি। আমার শিক্ষকেরা আছেন। তাঁদের অন্যভাবে জানার সুযোগ হয়েছে। এই ধরনের আদান-প্রদান আমাদের সমৃদ্ধ করবে।’