একটি প্রকল্পে নিজেদের কর্মীর যাতায়াতের জন্য ৬০২টি গাড়ি ভাড়া করা হবে। তাঁরা ওই সব জিপ, কার, মাইক্রোবাসে চড়ে প্রকল্প এলাকা চষে বেড়াবেন। কেউ ভবন নির্মাণের কাজ দেখতে যাবেন, কেউ প্রশিক্ষণ নিতে যাবেন। আবার কেউ কেনাকাটা করতে বাজারে যাবেন। আগামী তিন বছরে এসব গাড়ি ভাড়ায় খরচ হবে ৩৭ কোটি ৮ লাখ টাকা।
এখানেই শেষ নয়। প্রকল্প পরিচালক, উপপ্রকল্প পরিচালক ও বিভাগীয় সমন্বয়কেরা ভাড়ার গাড়িতে চড়বেন—তা হয় না। তাই প্রকল্পের বড় কর্তাদের জন্য চাই বিলাসবহুল জিপ গাড়ি। কেনা হবে নয়টি বিলাসবহুল জিপ। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মানে, প্রতিটি গাড়ির দাম পড়বে গড়ে ৮৫ লাখ টাকার বেশি।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘কোভিড–১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স ও পেনডামিক প্রিপার্ডনেস’ প্রকল্প পাস করা হয়। তিন বছরের এই প্রকল্পে এভাবেই গাড়ি কেনার পাশাপাশি গাড়ি ভাড়া করার বিশাল আয়োজন রাখা হয়েছে। এ জন্য প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা বরাদ্দও রাখা হয়েছে। প্রকল্পের মোট খরচ ধরা আছে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড থেকে সাধারণত প্রকল্পের গাড়ি কেনা হয়। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, প্রগতির তিনটি মডেলের জিপ গাড়ি আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি হলো জাপানের মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্টস (কিউএক্স) মডেলের জিপ। এর দাম ৯৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া মিতসুবিশি এএসএক্স এসইউভি মডেলটির দাম ৫৫ লাখ টাকা এবং ফোডে ল্যান্ডফোর্ট জিপের দাম পড়বে ৫৩ লাখ টাকা। এর মানে, ওই প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক, উপপরিচালকদের জন্য সবচেয়ে দামি জিপটিই কেনা হবে।
এখানেই শেষ নয়; এসব গাড়ির জ্বালানি হিসেবে গ্যাস, পেট্রল ও লুব্রিক্যান্ট কেনা বাবদ খরচ ধরা হয়েছে সব মিলিয়ে ৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে, প্রতিটি গাড়ির জন্য মাসে জ্বালানি বাবদ বরাদ্দ থাকবে প্রায় ১ লাখ টাকা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার টাকার জ্বালানি খরচ মিলবে। বর্তমান বাজার দরে এক লিটার পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা। তাহলে প্রতি গাড়িতে দৈনিক ৩৪ লিটার পেট্রল বরাদ্দ থাকবে। লিটার প্রতি ৫ কিলোমিটার মাইলেজ ধরলে এমন বিলাসবহুল গাড়িতে ওই জ্বালানিতে অন্তত ১৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া যাবে। জ্বালানির টাকা খরচ করতে প্রকল্প কর্মকর্তাদের এভাবেই গাড়ি নিয়ে দৌড়াতে হবে।
অথচ প্রকল্পটির মূল কাজ হলো দেশের ২১টি মেডিকেল কলেজে আধুনিক মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব স্থাপন; প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে আইসোলেশন সেন্টার এবং রাজধানীর মহাখালীতে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য ২৫০ শয্যার কোভিড হাসপাতাল চালু করা। এর পাশাপাশি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও প্রতিষেধক, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী কেনা হবে। যানবাহন খাত হলো প্রকল্পটির চতুর্থ বৃহত্তম খরচ খাত। ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গত ২ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট এই প্রকল্প পাস হয়, সেদিনই প্রায় একই ধরনের পৃথক কাজের জন্য এডিবির সহায়তায় আরেকটি প্রকল্প পাস হয়। ওই প্রকল্পের শিরোনাম ‘কোভিড রেসপন্স ইমারজেন্সি অ্যাসিসটেন্স’। এই প্রকল্পে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।
কাজের ধরন প্রায় একই রকম; তাই গাড়ির কেনার খরচ নিয়ে ওই দুটি প্রকল্পের মধ্যে তুলনা করা যেতে পারে। এডিবি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে গাড়ি কেনা বা ভাড়ার উৎসব তেমন একটা নেই। ওই প্রকল্পে মাত্র ২০টি গাড়ি ভাড়া করতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যাতায়াতের জন্য ১২টি গাড়ি কিনতে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। প্রতিটি গাড়ির দাম পড়বে গড়ে ৪৫ লাখ টাকা। জ্বালানি বাবদ খরচ ৮০ লাখ টাকা।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের পরিচালক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কাজী শামীম হোসেন গাড়ি কেনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পরিচালক হিসেবে কয়েক দিন আগে যোগ দিয়েছি। আরও কিছুদিন গেলে প্রকল্পের কাজ বুঝে এই বিষয়ে বলতে পারব। তবে কোনো ধরনের অসংগতি থাকলে অবশ্যই তা সংশোধন করা হবে।’
প্রশিক্ষণ-কর্মশালায় খরচ শত কোটি টাকা
ওই দুটি প্রকল্পই মূলত করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অবকাঠামো নির্মাণের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এডিবির সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে প্রশিক্ষণ, সভা-সেমিনারের খরচ করা হবে প্রায় শত কোটি টাকা। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ২২০টি অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের জন্য ৪৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর বিভিন্ন সভা-সেমিনারের জন্য আলাদা করে আরও ৪৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা খরচ করা হবে।
কিন্তু বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে ৫৩৫টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ খরচ রাখা আছে ২৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ এডিবির সহায়তার প্রকল্পের চেয়ে ৩১৫টি বেশি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে অর্ধেক খরচে।
বাড়তি খরচের আরও উদাহরণ আছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তার প্রকল্পে চারটি ওয়েবসাইট বানাতে সাড়ে ১০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি ওয়েবসাইট বানাতে খরচ পড়বে আড়াই কোটি টাকা।
প্রকল্পে প্রকল্পে গাড়িবিলাস
প্রকল্প মানেই যেন গাড়ি কিনতে হবে। প্রকল্প পরিচালকের ব্যবহারের জন্য অন্তত একটি গাড়ি চাই। এটি দীর্ঘদিনের চর্চা। একজন সরকারি কর্মকর্তা ৪-৫ প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করার নজির আছে। একাধিক প্রকল্প থেকে গাড়ির সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হওয়ার কিছুদিন পর প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য একটি আদেশ জারি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সেখানে কোন খাতে কত খরচ করতে হবে, এর চিত্র দেওয়া হয়। গত দুই মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ হওয়া এমন ১৫টি প্রকল্পের দলিলপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ১১টি প্রকল্পেই গাড়ি কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গাড়ির তেমন একটা প্রয়োজন নেই—এমন প্রকল্পেও গাড়ি কেনা হচ্ছে।
যেমন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ডাকাতিয়া নদীর ওপরে ১০৭ কোটি টাকা খরচ করে সেতু নির্মাণ করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ। চাঁদপুর সদর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে ওই সেতুর কাজ নিয়মিত পরিদর্শন করতে প্রকল্প পরিচালকের চলাচলের জন্য ৯৮ লাখ টাকায় জিপ কেনা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালকের জিপ কেনার জন্য বরাদ্দ আছে ৯০ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পে পিকআপ, মোটরসাইকেল, স্পিডবোট কেনার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে আরও ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
হাওর এলাকায় প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন করা হবে। ওই প্রকল্পের পরিচালকের হাওর এলাকা চষে বেড়ানোর জন্য গাড়ি লাগবে। তাই তিন বছরের জন্য গাড়ি ভাড়া করতে ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে। প্রতি মাসে গাড়িভাড়া বাবদ খরচ হবে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙন ঠেকাতে নেওয়া প্রকল্পেও ১ কোটি টাকার জিপ লাগবে। কেনা হবে ২৭০০ সিসির বিলাসবহুল জিপ। আর চারটি মাইক্রোবাসও কেনা হবে।
প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট মেরামত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ঘোড়াশালে পুরোনো একটি প্ল্যান্টকে ঢেলে সাজানো হবে। প্রকল্প এলাকা বলতে ওই ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকসহ অন্যদের চলাচলের জন্য ২৪টি গাড়ি কেনার বরাদ্দ ৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
প্রকল্পের গাড়ি সংস্কৃতি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দুভাবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, ‘প্রকল্পে অতিরিক্ত গাড়ি কেনা অপ্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের গাড়ির কারখানা নেই যে স্থানীয় শিল্পের লাভ হবে। গাড়ি কেনার মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ বৃদ্ধি পায়।’ তিনি আরও বলেন, শুরুতেই গাড়ি কেনায় প্রকল্প পরিচালকেরা আগ্রহ হয়ে ওঠেন। গাড়ি কেনা ও বিদেশ সফর শেষ হয়ে গেলে প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে আর আগ্রহ দেখান না তাঁরা। তাঁরা নতুন প্রকল্পে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেখানে আবার গাড়ি কেনা, প্রশিক্ষণ—এসবে নেমে পড়েন তাঁরা। একজন প্রকল্প পরিচালক এভাবেই ৪-৫টি প্রকল্প থেকে সুবিধা নেন।
করোনা পরিস্থিতিতে ব্যয় সাশ্রয় করতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে গাড়ি কেনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ওপরের বেশির ভাগ প্রকল্পের মেয়াদ দুই থেকে তিন বছর। ডিসেম্বরের পরে গাড়ি কেনা হলে ওই সব গাড়ি প্রকল্পের কাজে লাগবে মূলত দুই থেকে আড়াই বছর।
সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়িসুবিধা
বর্তমানে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণসুবিধা পান। এ ছাড়া ওই গাড়ির জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা পান। তাঁরা যখন প্রকল্পে পরিচালক হন, তখন প্রকল্প থেকেও গাড়িসুবিধা পান। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা যাতায়াতের জন্য নিজ নিজ দপ্তর থেকে গাড়ি পান।
নতুন প্রকল্প নেওয়া হলে এভাবেই গাড়ি কেনার খরচ রাখা হয়। গাড়ি ছাড়া যেন প্রকল্প চলে না। প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও নতুন আরেক প্রকল্পে ওই সব গাড়ি ব্যবহারের নজির খুব একটা নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এই বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, একটি প্রকল্পে এত গাড়ি কেনাকে ‘অপচয়’ ও ‘অপব্যবহার’—এই দুটো শব্দই যথেষ্ট। জনগণের টাকায় গাড়ি কিনে বিলাসিতা করেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। এ দেশের প্রকল্প সংস্কৃতিতে গাড়ি বিলাসিতা এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঢুকে গেছে। বিলাসিতার অবারিত দ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে। তাঁর মতে, কোন কোন প্রকল্পে কত গাড়ি কেনা হলো, এত গাড়ি প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, কোন ধরনের প্রকল্পে গাড়ি কেনা দরকার—তা নিয়ে সরকারের একটি পর্যালোচনা করা উচিত। এমন মূল্যায়ন সরকার আগে কখনো করেনি।