নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ

প্রকল্পে ‘খেয়ালখুশির’ নতুন নজির

  • ছয় বছর আগে পদদলিত হয়ে ১১ পুণ্যার্থীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী অবকাঠামো উন্নয়নের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

  • এত দিনেও নকশা করতে পারেনি গণপূর্ত অধিদপ্তর। এলজিইডি ৫২ কোটি টাকা ব্যয় করে ফেলেছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর ছয় বছর পেরোলেও নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাষ্টমী পুণ্যস্নান উৎসব এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি। অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে ঘাটসহ নির্মাণাধীন অবকাঠামো। সম্প্রতি লাঙ্গলবন্দ বাজার এলাকায়

সরকারের টাকায় ‘খেয়ালখুশিমতো’ প্রকল্প নেওয়ার নজির তৈরি হলো নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে। কথা ছিল, ব্রহ্মপুত্র নদের লাঙ্গলবন্দ অংশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাষ্টমীর পুণ্যস্নান উৎসব নির্বিঘ্ন করতে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে সমন্বিতভাবে। কিন্তু সরকারের তিন সংস্থা নিজেদের মতো করে তিনটি আলাদা প্রকল্প নিয়েছে। ব্যয়ের আয়োজন করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।

ঘাট, ছাউনি, পার্কিংয়ের মতো কিছু অবকাঠামো নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নিয়েছে ১২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প। রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নিয়েছে প্রায় ২৬০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প। আর গণপূর্ত অধিদপ্তর ব্যয় করতে চায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যার আওতায় হোটেল, থিম পার্ক, অ্যাম্ফিথিয়েটারসহ নানা অবকাঠামোর কথা বলা হয়েছে।

ইতিমধ্যে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয় করে ফেলেছে এলজিইডি। যদিও তাদের কাজের মাঝপথে বাদ সেধেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সবার আগে লাঙ্গলবন্দে পুণ্যস্নান উৎসব এলাকায় সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি করা হবে। যেসব নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল, সেগুলো বন্ধ থাকবে।

ব্রহ্মপুত্রে পুণ্যস্নান উৎসবের অবকাঠামো উন্নয়নে তিন সংস্থা দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের আয়োজন করেছে।

সব মিলিয়ে ফল এই যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার ছয় বছর পরও লাঙ্গলবন্দে পুণ্যার্থীরা তেমন কোনো অবকাঠামো সুবিধা পাননি। কবে পাওয়া যাবে, তাও অনিশ্চিত।

২০১৫ সালের ২৭ মার্চ স্নান উৎসবে পদদলিত হয়ে ১১ পুণ্যার্থীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী লাঙ্গলবন্দে অবকাঠামো উন্নয়নের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীরা প্রতিবছর এই লাঙ্গলবন্দে পুণ্যস্নানে যান। সেখানে জড়ো হন দেশ-বিদেশের ১০ লাখের বেশি নারী-পুরুষ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিজেদের স্বার্থেই সংস্থাগুলো নিজেদের মতো করে প্রকল্প নিয়েছে। আর সাধারণ অবকাঠামো উন্নয়নের বদলে বিলাসী নানা বিষয় যুক্ত করে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচের আয়োজন করেছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও। লাঙ্গলবন্দে উন্নয়ন প্রকল্পে সমন্বয়ের জন্য গঠিত আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির একটি সভা গত ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, এতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব সাজ্জাদুল হাসান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শুধু অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামো নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। হোটেল, রেস্টহাউস, অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো উচ্চাভিলাষী উপাদান প্রকল্প থেকে বাদ দিতে হবে। বিশৃঙ্খলভাবে অবকাঠামো নির্মাণের ফলে নদীর প্রবাহও বিঘ্নিত হয়েছে।

উদ্যোগ ছয় বছর আগের

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর লাঙ্গলবন্দে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ২০১৫ সালের ১ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। নথিপত্র অনুযায়ী, সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে স্থাপত্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় গণপূর্ত অধিদপ্তর এক মাসের মধ্যে পুণ্যস্নান এলাকার দৃষ্টিনন্দন নকশা প্রস্তুত করে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাবে। সে নকশা ধরে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করবে এলজিইডি। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর স্থানীয় রাস্তা প্রশস্ত করবে। আর অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) পুণ্যস্নানের ১১ কিলোমিটার নদ খনন করে নাব্যতা বজায় রাখবে।

যদিও সেই নকশা আর হয়নি। এর মধ্যে এলজিইডি নিজেদের মতো করে অবকাঠামো তৈরির জন্য প্রায় ১২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।

নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ থেকে মিনারবাড়ী পর্যন্ত প্রায় পৌনে চার কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করতে আরেকটি প্রকল্প নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। তবে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু তাতেও কাজ এগোয়নি। ২০২০ সালের জুলাইয়ে ১৩৯ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। জমি অধিগ্রহণের জন্য এ ব্যয় বাড়ে। কিন্তু প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজ এখনো শুরু হয়নি।

এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তর লাঙ্গলবন্দ এলাকার উন্নয়নে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে। ২০২০ সালে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করে প্রকল্পটি তারা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নের সময় নারায়ণগঞ্জে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন মুহাম্মদ জাকির হোসেন। বর্তমানে তিনি দিনাজপুর গণপূর্ত সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়নকাজ করার কথা। এলজিইডি তাড়াহুড়ো করে ছোট পরিসরে তাদের প্রকল্পটি নেয়।

সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার এটি একটি প্রকট উদাহরণ। প্রতিটি সংস্থার ধারণা, কোনোভাবে একটি বড় প্রকল্প পাস করাতে পারলেই নিজেদের লাভ।
আদিল মুহাম্মদ খান, সাধারণ সম্পাদক, বিআইপি

নতুন করে নকশা

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গণপূর্ত প্রকল্প প্রস্তাবটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে বলা হয়, লাঙ্গলবন্দ নিয়ে একই ধরনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। তাই তিন পক্ষের এ নিয়ে বসা উচিত। একপর্যায়ে লাঙ্গলবন্দের উন্নয়ন প্রকল্প সমন্বয়ের জন্য একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে গত ৭ ডিসেম্বরে এই কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে গণপূর্ত নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকবে না। কারণ, তারা ছয় বছরেও কাজটি করতে পারেনি। নতুন করে মহাপরিকল্পনা করবে এলজিইডি। এতে স্থাপত্য অধিদপ্তর পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের পরেই উন্নয়নকাজ আবার শুরু হবে।

এলজিইডির লাঙ্গলবন্দ পুণ্যস্নান উৎসবের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক গৌতম প্রসাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মহাপরিকল্পনা ছাড়া কাজ করা যাবে না, সেটি এত বছর বলা হয়নি। যখন প্রকল্প একনেকে পাস হয়, তখনো কিছু বলা হয়নি। তাঁদের প্রকল্পের বেশ কিছু কাজ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি বলেন, মহাপরিকল্পনা করার পরে এলজিইডির বর্তমান প্রকল্প সংশোধন করা হতে পারে।

অর্ধসমাপ্ত ঘাট, যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী

লাঙ্গলবন্দে এলজিইডির নেওয়া ১২১ কোটি টাকার প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৫২ শতাংশ। প্রস্তাবিত ১৫টি ঘাটের মধ্যে ৮টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সড়কের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে। পার্কিং নির্মাণের কাজ শেষের দিকে। তবে নতুন করে মহাপরিকল্পনা করতে বলায় নির্মাণকাজ ছয় মাসের বেশি সময় ধরে থেমে আছে।

লাঙ্গলবন্দ বাসস্ট্যান্ডে নেমে কিছুটা এগোলেই পুণ্যস্নানের ঘাটের দেখা মেলে। গত ২৩ মার্চ সরেজমিনে দেখা যায়, লাঙ্গলবন্দ বাজারের আগেই একটি ‘ডরমিটরি’ নির্মাণের কাজ অর্ধসমাপ্ত ফেলে রাখা হয়েছে। বাজারের আগে দুটি অর্ধনির্মিত ঘাট। ঘাটের সঙ্গে পারের সংযোগ নেই। আশপাশের বাড়ির লোকজন বাঁশের সিঁড়ি লাগিয়ে ঘাটে গোসল করছেন।

বাজার থেকে কিছুটা সামনে এগোলে ভদ্রেশ্বরী কালীঘাট। এর আশপাশে তিনটি নতুন ঘাট তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ হয়নি। শুধু একটি ঘাটের পিলার তোলা হয়েছে। অবকাঠামো তৈরির জন্য আনা নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়েছে।

লাঙ্গলবন্দ স্নান উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুজিত সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিনেও কাজ শেষ না হওয়ার জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থার দোষ দেয়। দ্রুত কাজগুলো শেষ হোক, এটাই আমাদের চাওয়া।’

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন যে ঘাটগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সংযোগ নেই। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঘাটগুলো এমনভাবে তৈরি হবে যেন একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত থাকে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গেলে নবনির্মিত ও অর্ধনির্মিত ঘাটগুলো ভাঙতে হতে পারে। তবে এলজিইডি নিজেদের করা অবকাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে মহাপরিকল্পনা করার চেষ্টা করছে।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার এটি একটি প্রকট উদাহরণ। প্রতিটি সংস্থার ধারণা, কোনোভাবে একটি বড় প্রকল্প পাস করাতে পারলেই নিজেদের লাভ। অথচ প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ছিল, পুণ্যার্থীরা যে উদ্দেশ্যে আসবেন, তা যেন ভালোভাবে পালন করতে পারেন।’ তিনি বলেন, এই সাধারণ বিষয় মাথায় রাখলে সাধ্য অনুযায়ী এবং সহজে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প নেওয়া যেত।