>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
‘আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল। অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি। সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!’ হ্যাঁ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতা ‘অমলকান্তি’র কথা প্রায়ই মনে পড়ে যায়। তবে ছোটবেলায় আমার রোদ্দুর ছুঁতে মন চাইত। মানে বৈমানিক হওয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিল। মেঘেদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে রোদ্দুর ছোঁয়ার তুমুল ইচ্ছে একসময় ফসকে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ঢুকে পড়ি করপোরেট দুনিয়ায়। নানা কাজের ভাঁজে আটকে গেলেও ছেলেবেলার সেই অভিনয় করার শখ প্রায়ই মনের মাঝে উঁকি দিত। মূলত এভাবেই শুরু আমার অভিনয়জীবন। ২০১৫ থেকে ২০২০। শোবিজ অঙ্গনে প্রায় পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। শুরু করেছিলাম এফ কিউ পিটারের দ্য হিরো টেলিফিল্মে শক্তিমান অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে। অভিনয়ের শখটা মূলত সেই ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি কখনো। আর সেই সুযোগটা যখন পেলাম, তখন প্রথমে ভেবেছিলাম কয়েকটা কাজ করে ফিরে যাব নিজের চেনা ভুবনে। কিন্তু তা আর হয়নি। শোবিজ থেকে আসলে কারও কখনো ফেরা হয় না। এটা হলো একটা মায়ার জগৎ। কাজ করতে করতে কেমন জানি একটা ভালো লাগা শুরু হয়ে যায়। তাই ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েছি এই জগতের মায়ায়।
আর সে জন্য এখন অভিনয়কে মনে করি আমার আরেকটা কাজ। সেই কাজের সংখ্যাও আস্তে আস্তে বাড়ছে প্রতিবছর। ইতিমধ্যে ছোট পর্দায় সব কটি মাধ্যমেই বিস্তৃত হয়েছে পথচলা। নাটক আর টেলিফিল্ম দিয়ে শুরু করলেও একসময় ধারাবাহিকেও কাজ করা শুরু করেছি। মিউজিক ভিডিও, ওয়েব সিরিজ, অনলাইন কনটেন্টস আর স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতেও কাজ করছি এখন। ২০১৮ থেকে শুরু করি বিজ্ঞাপনের কাজ। সংবাদপত্র, টেলিভিশন আর অনলাইনের জন্য। দুটো সিনেমায় কাজ করেছি। সাপলুডু আর বিশ্বসুন্দরী।
পেশাগত জীবনে আমি কমিউনিকেশন, মার্কেটিং, ইনফরমেশন আর জনসংযোগ সেক্টরের পেশাজীবী মানুষ। তিন দশকের এই কর্মজীবনে কাজ করেছি দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। শুরু করেছিলাম একটি জাতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়। তারপর একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করার পরে চলে আসি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ব্যাংকিং সেক্টরে। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ডাচ্–বাংলা ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরে এখন কাজ করছি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে। কমিউনিকেশন ভুবনের বাইরেও যে একদিন শোবিজে আমার আরেকটা জগৎ তৈরি হবে, কোনো দিনও ভাবিনি।
চাকরিজীবনের মতো এই পাঁচ বছরে শোবিজেও তৈরি হয়েছে অনেক সহকর্মী, পরিচিত আর প্রিয় মুখ—শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার, কলাকুশলী আর শুভাকাঙ্ক্ষী। আমার ফেসবুক একসময় ছিল শুধু আমার ফ্রেন্ডস আর ফ্যামিলি নিয়ে। পরে চাকরিজীবনের অনেক সহকর্মীও ধীরে ধীরে যুক্ত হলেন এখানে। আর এখন আমার ফেসবুকে এই শোবিজের মানুষের সংখ্যাই মনে হয় বেশি। আর এভাবেই কমিউনিকেশনের একজন পেশাজীবী এই আমি, আজ অনুভব করি আমার এই পরিবর্তনকে।
মন্দ লাগেনি ব্যাপারটাকে। অন্য প্রাণজাগানিয়া ভালো লাগা কাজ করে। শোবিজে অনেক দেরিতে হয়তো এসেছি। কিন্তু একদম শেষে তো আর আসিনি। কোনো কাজেই শেষ বলে বোধ হয় কিছুই নেই। সব কাজেরই একটা শুরু আছে। যা আমি প্রচণ্ড বিশ্বাসও করি।
তবে শুরুতে আমাকে নিয়ে শোবিজের মানুষের কিছু ভুল বিশ্বাসও ছিল। ছিল বলাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না, এখনো হয়তো আছে। অনেকেই আমাকে ভাবতেন, আমি অভিনেতার পাশাপাশি একজন প্রযোজক। ছোট পর্দার একজন জনপ্রিয় নির্মাতা, যার অর্ধশতাধিক কাজ আমি করেছি। অনেকেই ভেবেছেন, আমি তার এই কাজগুলোর প্রযোজক।
আবার কমিউনিকেশনস বিষয়ক কাজ করার কারণে অনেকেই প্রত্যাশা করেন তাঁদের কাজের স্পন্সরশিপের। এমন অনুরোধ শুনতে হয় প্রায়ই। তখন তাঁদের আবার বলতে হয়। চাকরি আর অভিনয়—দুটোই আমার কাছে কাজ। আর এই দুটো কাজের রয়েছে নিজস্ব নীতি আর ধারা। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী আমাকে অফিসের কাজ করতে হয়। স্ক্রিপ্টে চরিত্র থাকলে আর ডিমান্ড করলেই একজন পরিচালক আমাকে কাস্টিং করে থাকেন। তাই দুটোকে একসঙ্গে মেলালে চলবে না। একবার একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের কর্ণধার তো ভীষণ ভুল বুঝেছিলেন। পরে তাঁকেও বোঝাতে হয়েছে এবং পেরেছিও বোঝাতে।
টেলিভিশন বলতে আমরা ছোটবেলা থেকে সাদাকালো সময়ের বাংলাদেশ টেলিভিশনকেই চিনতাম। ১৯৮০ থেকে বিটিভি রঙিন সম্প্রচার শুরু করে। এর অনেক পরে আকাশসংস্কৃতি শুরু হয়। আসে স্যাটেলাইট টেলিভিশন।
আর অন্যদিকে সাদাকালো সিনেমা থেকে প্রথমে আংশিক রঙিন এবং পরে সম্পূর্ণ রঙিন সিনেমার যুগ শুরু হয়। ছোটবেলার কথা মনে আছে, প্রতি সপ্তাহে দু-তিনটা করে নতুন সিনেমা মুক্তি পেত। আর সংবাদপত্রের পূর্ণ পাতাজুড়ে থাকত সেই আসন্ন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির বিজ্ঞাপন। সঙ্গে আরও থাকত পরের সপ্তাহের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির বিজ্ঞাপন। রেডিওতে বিজ্ঞাপন তরঙ্গ অনুষ্ঠানে থাকত ১৫ মিনিটের প্রমোশনাল অনুষ্ঠান। সেই মায়াবী গলার আহ্বান, হ্যাঁ ভাই, আসিতেছে...। আমি আশির দশকের কথা বলছি। তখন সারা দেশে ছোট–বড় সিনেমা হলের সংখ্যাও ছিল অনেক। যতটুকু মনে পড়ে, চট্টগ্রামের উপহার আর যশোরের মণিহার ছিল সবচেয়ে বড় হল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কেমন জানি আজ বদলে যাচ্ছে। দেশে এখন অনেক টেলিভিশন চ্যানেল। প্রচুর কাজও হচ্ছে ঈদ ও অন্যান্য জাতীয় বা গুরুত্বপূর্ণ দিবসে। কিন্তু দর্শক তা দেখছে না। বা দেখতে পারছে না। পে চ্যানেল না হওয়ার কারণে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে নির্ভর করতে হচ্ছে বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর। ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুষ্ঠান দেখার আনন্দ থেকে দর্শকবঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে কপিরাইট না থাকায় পুনঃপ্রচারিত প্রোগ্রামগুলোর শিল্পী ও কলাকুশলীরাও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
অন্যদিকে আগের সিনেমা হলগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার না হওয়ায় আর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় ধীরে ধীরে এগুলোর সংখ্যাও কমতে শুরু করে। সিনেমা হলগুলোর মালিক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম অনাগ্রহী হয়ে পড়ে এই ব্যবসায়। আজকে নতুন প্রজন্মের সিনেমা ব্যবসায়ীরা সিনেপ্লেক্স গড়ে তুলেছেন ঠিকই, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
সময় কারও জন্য কখনো থেমে থাকে না। আর তাই হয়তো সিনেমা হলের পরিবর্তে এখন সিনেপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। আর টেলিভিশনের বিকল্প হিসেবে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। নাটক, টেলিফিল্ম ধারাবাহিক, সংগীত, সিনেমা—সবকিছুই এখন দেখা যাচ্ছে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে।
তারপরও শোবিজের সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছে এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। প্রায় তিন মাস সব কাজ বন্ধ ছিল শোবিজের। এই ভাইরাসের কারণে আমরা সবাই চলে গিয়েছিলাম ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এ। আর ওয়ার্ক ফ্রম হোম থেকে অনেকেই আমরা অনেক কাজ করেছি অফিসের, ব্যবসা-বাণিজ্যের, চিকিৎসা, শিক্ষকতা, সংগীত, নৃত্য কিংবা লেখালেখির। কিন্তু শুধু পারিনি অভিনয় করতে। কারণ, এটা তো একা একা করা যায় না। তারপরও কিছু কিছু একা কনটেন্ট অনেকে করেছেন কিছু করার তাড়না থেকে।
আর তাই শোবিজের সবচেয়ে বড় মৌসুম রোজার ঈদে জমানো বা আগের করা কাজ দেখতে হয়েছে দর্শকদের। আর সিনেমার অবস্থা তো আরও খারাপ। একটা সিনেমাও মুক্তি পায়নি। কারণ, সিনেমা হল তো বন্ধ।
কিন্তু মানুষের বিনোদনের চাহিদা তো কমেনি। সেই প্রত্যাশার খোঁজে মানুষ ঘুরে বেড়িয়েছে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো একসময় হয়তো এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মনির্ভর হয়ে পড়বে আমাদের শোবিজ।
এমনই এক বাস্তবতায় পাঁচ বছর পার করলাম এই শোবিজে। ভালোমন্দ অনেক স্মৃতি নিয়ে। তারপর এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যাব এই মায়ার জগতে।
আজকে মনে পড়ছে কণ্ঠশিল্পী চন্দন সিনহা আর এটিএন বাংলার মীর মোতাহার হাসানকে। যাঁরা আমাকে নিয়ে এসেছিলেন এই জগতে, আর নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীকে। যিনি তাঁর অর্ধশতাধিক কাজে আমাকে সুযোগ দিয়েছেন স্ক্রিনে থাকার। সবার ভালোবাসায় যেন এগিয়ে যেতে পারি ভবিষ্যতে।
তার আগে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠুক মানুষের জীবনযাপন। সুস্থ আর সুন্দর হোক পৃথিবী। সেই সঙ্গে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
* লেখক: অভিনেতা। azamshowbiz2015@gmail.com