দীর্ঘ নাটকীয়তা ও শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষার পর ২৫ জুন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হচ্ছে স্বপ্ন, আবেগ ও আত্মমর্যাদার পদ্মা সেতু। আমাজনের পর পদ্মা পৃথিবীর দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের স্রোতোধারা মিলে ২৯৫ মিটার গড় গভীরতার এ অববাহিকা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ মিটার গতিবেগে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পলিমাটি পরিবহন হয় তৃতীয় বৃহত্তম এ নদীর মাধ্যমে। প্রমত্ত ও দোলাচলের পদ্মার ওপর নির্মিত ভায়াডাক্টসহ ৯.৮৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ও ২২.৫ মিটার প্রস্থের ৪ লেনবিশিষ্ট এ সেতু পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ নদী পারাপার।
বর্ষাকালে পদ্মা প্রবল খরস্রোতা রূপ নিলে নদীতলে যে গভীর ‘স্কাউর’ বা ঘর্ষণজনিত তোলপাড় সৃষ্টি হয়, তা দুনিয়ায় বিরল। পদ্মা সেতুর নির্মাণস্থলে শক্তিশালী ‘সাইজমিক’ কর্মকাণ্ড চলমান থাকায় উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পসহ একটি কাঠামো তৈরি করাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যুক্ত হয় পিলারের সঙ্গে জাহাজের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঝুঁকি। তার ওপরে আছে প্রবল ঘূর্ণি ও মৌসুমি বায়ুচাপ। জাহাজ চলাচলের সুবিধা রাখতে গিয়ে সেতুটির দুটি পিলারের মধ্যখানে স্প্যানের পরিমাপ দাঁড়ায় ১৫০ মিটার এবং পানির উপরিভাগ থেকে সেতুর তলা পর্যন্ত ‘ক্লিয়ারেন্স’ রাখতে হয় ১৮ মিটার।
বিদ্যমান প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় পৃথিবীর সেরা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়াররাও রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে যান! কম্পিউটার সিম্যুলেশনে ‘এক্সিয়াল, শিয়ার ও বেন্ডিং লোড’ বিবেচনায় সেতুটির যে বিশাল কাঠামো দাঁড়ায়, তাতে প্রকৌশল ও আর্থিক বিবেচনায় এ সেতু নির্মাণ অবাস্তবসম্মত হয়ে পড়ে। প্রকৌশলীরা একরকম হালই ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমন সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সেতুটিতে রেলপথ যুক্ত করার নতুন চাহিদা আসে, আর এতেই খুলে যায় পদ্মা সেতুর কারিগরি সম্ভাবনার দ্বার!
বস্তুত বাড়তি রেলপথ বিবেচনা করতে গিয়েই স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের মাথায় প্রথমবারের মতো ‘টু-লেভেল’ কাঠামোর চিন্তাটা আসে। তৈরি করা হয় কংক্রিট ডেক–সংবলিত বিকল্প তিনটি মডেল—একস্ট্রা ডোজ কংক্রিট ট্রাস, কংক্রিট গার্ডার ও স্টিল ট্রাস সেতু। প্রকৌশলীদের বিস্মিত করে দিয়ে পাতলা স্ল্যাব ও স্টিল ট্রাসের তৃতীয় মডেলটি পদ্মা সেতু নির্মাণে নতুন আশার সঞ্চার করে। যেখানে স্টিল ও কংক্রিট সমন্বিতভাবে যাবতীয় ভার বহন করবে। এ চিন্তাকে আরেকটু বিস্তৃত করে সড়কপথ ও রেলপথের জন্য পরিকল্পনা করা হয় পৃথক দুটি ‘এনভেলপ’ এবং রেললাইনটি নিয়ে আসা হয় ট্রাসের ভেতর দিয়ে নিচের ডেকে বা তলে। তাতে রেললাইনের ‘ভায়াডাক্ট’টিও নেমে আসে মাত্র আধা কিলোমিটারে। এত বড় সেতুর ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিনব একটি ‘টু-লেভেল ও টু-এনভেলপ ডিজাইন’ পৃথিবীতে এটাই প্রথম।
ডিজাইনের অংশ হিসেবে দ্বিতীয় ডেকটি হাতে পেয়ে প্রকৌশলীরা তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। এর মধ্য দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন, হাই-ভোল্টেজ বিদ্যুৎলাইন ও টেলিসংযোগের তার পরিবহন করার সুবিধা রাখা হয়েছে। সেতু কাঠামোর সার্বিক ওজন সীমিত পর্যায়ে রাখতে পদ্মা সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছে মিহি দানার বিশেষ সিমেন্ট এবং অতি উচ্চ ক্ষমতার স্টিল, যা পুরোপুরি জোগান দিয়েছে আমাদের দেশীয় কারখানাগুলো। সেতুটির ‘ডিজাইন লাইফ’ ১০০ বছর হলেও সম্পূর্ণ মডুলার স্ট্রাকচারে নির্মিত হওয়ায় যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ÿক্ষয়ক্ষতি আংশিকভাবে মেরামত করে এ সেতু আরও কয়েক গুণ সময় ধরে ব্যবহার করা যাবে। এটিও পদ্মা সেতুর আরেকটি দুর্লভ বৈশিষ্ট্য!
অভিনব ‘টু-লেভেল ও টু-এনভেলপ’ কাঠামোতে দাঁড়িয়ে গেল পদ্মা সেতুর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন। কিন্তু পাইলিং করতে গিয়ে দেখা গেল আরেক বিপত্তি! ৬৫ মিটার পর্যন্ত নরম কাদামাটি সরিয়ে পাওয়া গেল শক্ত নদীতল। ৬: ১ কৌণিক অনুপাতে স্টিলের পাইলগুলোকে ড্রাইভ করা হলো ১২০-১২২ মিটার গভীরে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম! এ কাজের জন্য জার্মানি থেকে আনা হয়েছে ২৫ হাজার মেট্রিক টন আঘাত হানতে সক্ষম ‘হাইড্রোলিক হ্যামার’ এবং বিশাল আকৃতির ট্রাস বহনে চীন থেকে বানানো হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন সক্ষমতাসম্পন্ন ভাসমান ক্রেন। এ দুটিই বিশ্বের নতুন রেকর্ড!
প্রায় ৮ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প মোকাবিলায় ‘সাইজমিক আইসোলেশন’ প্রযুক্তিতে পিলারের মাথা ও ট্রাসের মাঝখানে স্থাপন করতে হয়েছে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টিকারী ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজন বহনে সক্ষম ‘পেন্ডুলাম বিয়ারিং’। এতে ভূমিকম্পজনিত লোড পৃথক করে ফেলায় প্রতিটি পিলারে পাইলের সংখ্যা প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত ৮টি থেকে কমিয়ে ৬টিতে নামিয়ে আনা হয়, যাতে ফাউন্ডেশনের খরচ সাশ্রয় হয় ২০ শতাংশ। ট্রাসের সেকশনের আকারও কমে আসে ৬ শতাংশ। প্রকৌশল ও ব্যয় সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে অনুরূপ অন্তত ৩০টি নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে পদ্মা সেতুকে ঘিরে।
পদ্মা সেতুর সামগ্রিক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নদীশাসন হয়ে ওঠে একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দুরন্ত পদ্মাকে বশ মানাতে তার তলদেশে ফেলা হয়েছে ১ টন পর্যন্ত ওজনের ৩৮ লাখ টন পাথর এবং ১৪ কিলোমিটার পাড় রক্ষায় স্থাপন করা হয়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ টন কংক্রিট ব্লক এবং ২ কোটি স্থিতিস্থাপক জিও ব্যাগ। তবে সব ক্ষেত্রেই ইলিশ মাছসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখতে বিশেষ নজর রাখা হয়েছে।
সব প্রকৌশল ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা শেষে সর্বোচ্চ কাজের মান নিশ্চিত করে ৪২টি পিলার বা স্তম্ভ ও ৪১টি স্প্যান বা বিস্তারের ওপর নির্মিত হয়েছে সড়ক, রেল ও নদীপথের সুবিধা নিয়ে ‘ত্রিমাত্রিক’ এ সেতু। কিন্তু এ মহাযজ্ঞের সবচেয়ে শক্তিশালী যে স্তম্ভ, তা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংকল্প, যার শিকড় বাংলার মাটির অনন্ত গভীরে প্রোথিত। পদ্মা সেতু তার সুদৃঢ় ভিত্তি ও সুঠাম কাঠামো নিয়ে আজ পার্থিব সব চাপ সহ্য করতে সক্ষম, কিন্তু এ স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে যত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও চাপ সহ্য করতে হয়েছে, তা পরিমাপেরও অতীত।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, প্রকৌশল উৎকর্ষ ও সামগ্রিক পারঙ্গমতার পাশাপাশি জাতি হিসেবে আমাদের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সোপান। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে বীর বাঙালি বড় একধাপ এগোল। মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। কীর্তিনাশা পদ্মার ওপর নির্মিত এ সেতু বাংলাদেশের জন্য অভাবনীয় এক কীর্তি—নতুন এক ‘নেশন ব্র্যান্ডিং’! এ সেতু দেশের এক-তৃতীয়াংশ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সংযুক্ত করার পাশাপাশি জিডিপিতে জোগান দেবে অন্তত ২ দশমিক ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার ওপর দাঁড়ানো এ মহা স্থাপনাটিকে তিনি নিজ নামে নামকরণ না করলেও অনাগত কাল ধরে বাংলার মানুষ সেতুটিকে ‘শেখ হাসিনার সেতু’ হিসেবেই জানবে।
পদ্মা সেতুর সামগ্রিক প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সড়ক–রেলপথসহ মূল সেতুর নির্মাণ ব্যয় সাকল্যে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। ডিজাইন কমপ্লেক্সিটি, নির্মাণশৈলী ও ভৌত কাজের সার্বিক পরিমাণ বিবেচনায় পদ্মা সেতু ইতিমধ্যেই বিশ্বপরিমণ্ডলে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী স্থাপনা’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বহুবিধ অভিনব, লাগসই ও অগ্রসর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে যা নিজেই আজ হয়ে উঠেছে পৃথিবীর নতুন এক ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ান্ডার’ বা ‘প্রকৌশল অত্যাশ্চর্য’! বহু নির্মাণকৌশল এ সেতুতে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হওয়ায় স্থান মিলেছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
লেখক: প্রকৌশলী ও একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক