পুড়েছে ১০০ কনটেইনারের পণ্য

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ডিপোর কার্যক্রম অচল থাকায় চাপ পড়বে অন্য ডিপোগুলোতে।

শনিবার রাতের বিস্ফোরণে ও আগুনে পুড়ে যাওয়া কনটেইনারগুলোয় ভেতর কোনো মরদেহ আছে কি না, তা খুঁজে দেখছেন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। গতকাল সকাল নয়টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে

ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক হিসাবে সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণে প্রায় ১০০ কনটেইনারের পণ্য পুড়েছে। এসব পণ্যের বেশির ভাগই তৈরি পোশাক খাতের, যা রপ্তানির জন্য ডিপোতে নেওয়া হয়েছিল।

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ডিপোর কার্যক্রম অচল থাকায় চাপ পড়বে অন্য ডিপোগুলোতে। তাঁরা বলছেন, সাধারণত ঈদের আগে পণ্য রপ্তানি বাড়ে। অন্যদিকে আগুন নেভানোর পর ডিপোতে অক্ষত পণ্য রপ্তানি নিয়েও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।

গত শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ ৪৩ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক। প্রায় ৬১ ঘণ্টা পর গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে সেনাবাহিনী ঘোষণা দেয়।

শনিবার ডিপোর মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত ছাউনির পশ্চিম দিকের কনটেইনারে আগুন থেকে বিস্ফোরণ হয়। গতকাল দেখা যায়, বিস্ফোরণে ছাউনি ও পশ্চিম দিকে কয়েক স্তরে থাকা কনটেইনার পণ্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবে ছাউনির পূর্ব ও দক্ষিণ পাশের কনটেইনারগুলো অক্ষত দেখা গেছে। এসব কনটেইনারে আমদানি-রপ্তানি পণ্য রয়েছে।

এখন অক্ষত পণ্য রপ্তানি কীভাবে হবে, তার একটি পথ খুঁজে বের করা উচিত। কারণ, এসব কনটেইনার রপ্তানি করা না গেলে রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম সহসভাপতি, বিজিএমইএ

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিনের আগুনে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, কমবেশি ১০০টি কনটেইনারের পণ্য পুড়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিস গতকাল প্রাথমিক যে তথ্য দিয়েছে, তাতে ডিপোতে থাকা বেশির ভাগ কনটেইনার অক্ষত রয়েছে বলে জানা গেছে। এ হিসাবে আনুমানিক আমদানি-রপ্তানি পণ্যের এক হাজার একক কনটেইনার অক্ষত রয়েছে, যেগুলোর সিংহভাগই রপ্তানি পণ্য। এসব পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগই পোশাক খাতের।

রপ্তানিতে দুশ্চিন্তা

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর গতকাল থেকে অক্ষত পণ্য রপ্তানি কীভাবে হবে, তা নিয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এসব কনটেইনার দ্রুত রপ্তানি করা না গেলে পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছে তারা। এ জন্য অন্য ডিপোতে নিয়ে কাগজপত্র ঠিক করে বন্দর দিয়ে জাহাজে তুলে দিতে চায় তারা।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিস্ফোরণে প্রাণহানি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন অক্ষত পণ্য রপ্তানি কীভাবে হবে, তার একটি পথ খুঁজে বের করা উচিত। কারণ, এসব কনটেইনার রপ্তানি করা না গেলে রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার এই ডিপো ব্যবহারে যেসব বিদেশি ক্রেতা চুক্তিবদ্ধ ছিলেন, তাঁদের এখন অন্য ডিপোর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। বিএম ডিপোর রপ্তানি পণ্যের জট খোলার জন্য বিদেশি ক্রেতা, বাংলাদেশ ব্যাংক, কাস্টমস ও বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এসব প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা না গেলে সমস্যা কাটবে না।’

সীতাকুণ্ডের এই ডিপো ব্যবহার করে পণ্য নিত পোশাক খাতের এইচঅ্যান্ডএম, টার্গেট করপোরেশন, এমবিএইচ, বেস, ফেম এলএলসিসহ বিশ্বের বড় ক্রেতারা। চট্টগ্রামে বেসরকারি খাতে ১৯টি কনটেইনার ডিপো রয়েছে। এর মধ্যে বিএম ডিপোর মাধ্যমে মোট রপ্তানির ৮ শতাংশের ব্যবস্থাপনা হতো।

আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ডিপোতে রাসায়নিকের জার রয়েছে। রাসায়নিক পদার্থ ঝুঁকিমুক্ত করে ডিপোর অক্ষত কনটেইনার নেওয়া সম্ভব হবে।
পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দি, ফেনী ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক

জানতে চাইলে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির সভাপতি নুরূল কাইয়ূম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ডিপো আগের মতো সচল হতে অনেক মাস লেগে যেতে পারে। এই চাপ এখন অন্য ডিপোগুলোর ওপর পড়বে। চাপ সামলাতে অন্য ডিপোগুলোর হিমশিম খেতে হবে। কারণ, প্রতিনিয়ত রপ্তানি বাড়ছে। এই চাপ যাতে মোকাবিলা করা যায়, সে জন্য বন্দরে আমরা রপ্তানি পণ্য রাখার জায়গা বাড়ানোর অনুরোধ করেছি।’

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৯০ শতাংশেরই ব্যবস্থাপনা করে চট্টগ্রামের বেসরকারি ১৯টি ডিপো। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, গত অর্থবছরে রপ্তানি হওয়া ৩৮ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সাড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানির ব্যবস্থাপনা করেছে এসব ডিপো।

রপ্তানিকারকেরা কারখানা থেকে কাভার্ড ভ্যানে পণ্য এনে ডিপোর ছাউনিতে রাখেন। সেখানে কাস্টমসের শুল্কায়নপ্রক্রিয়া শেষে রপ্তানিকারকের প্রতিনিধিরা বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেন। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা রপ্তানি পণ্য কনটেইনারে বোঝাই করে বন্দর দিয়ে জাহাজে তুলে দেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফেনী ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ডিপোতে রাসায়নিকের জার রয়েছে। রাসায়নিক পদার্থ ঝুঁকিমুক্ত করে ডিপোর অক্ষত কনটেইনার নেওয়া সম্ভব হবে।

পণ্যের ক্ষয়ক্ষতি

সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ ও আগুনে কনটেইনার, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, ডিপোর ছাউনিতে থাকা রপ্তানি পণ্য, কাভার্ড ভ্যান ও কনটেইনার পরিবহনকারী গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আগুন লাগার আগের দিন বিএম ডিপো থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে যে তথ্য পাঠানো হয়েছে, তাতে দেখা যায়, ওই দিন ডিপোতে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ছিল ৮৬৭ একক। আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার ছিল ৫৫৭ একক। খালি কনটেইনার ছিল ২ হাজার ৮৯৪টি। এক দিনের ব্যবধানে রপ্তানি কনটেইনারের সংখ্যা সামান্য কমবেশি হতে পারে।

গত অর্থবছরে বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া কনটেইনারের গড়ে রপ্তানি মূল্য ৩৮ লাখ টাকা। আমদানি কনটেইনারে ২০-২২ লাখ টাকার পণ্য থাকে। এ হিসাবে ১০০ কনটেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৩০-৩৮ কোটি টাকার পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর বাইরে ছাউনিতে থাকা কার্টনে সব পণ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।

তবে বিজিএমইএ সদস্যপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে হিসাব নিয়ে প্রাথমিক ক্ষতির হিসাব তৈরি করছে। তাতে দেখা যায়, এ পর্যন্ত ২৮ পোশাক কারখানার ৩০ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৪ পিস পোশাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যার রপ্তানি মূল্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৫৯৬ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৯২ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৫ কোটি টাকা। এসব পণ্য কনটেইনার ও ছাউনিতে কার্টনে রাখা ছিল।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি কৃষ্ণ চন্দ্র দাস]