পুলিশে চাকরি হওয়া থেকে বাবুলের পরিবর্তন শুরু: মিতুর মা

মাহমুদা খানম মিতুর মা সাহেদা মোশাররফ
ছবি: আসাদুজ্জামান

বাবুল আক্তার ও মাহমুদা খানম মিতু দুজনের বাবাই পুলিশে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে পরিচয় থেকে পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়। দুই দশক আগে যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন বাবুল পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন না।

ঝিনাইদহের ছেলে বাবুল তখন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের ছাত্র। এরপর কয়েক বছর ব্যাংকের চাকরির পাশাপাশি লেখাপড়া করে বিসিএসে পুলিশের চাকরি পান তিনি।

এরপরেই বাবুল আক্তারের আচরণে পরিবর্তন আসে বলে জানিয়েছেন মাহমুদা খানম মিতুর মা সাহিদা মোশাররফ। পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছিলেন মিতু। সে সময় পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে যোগ দিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন বাবুল।

চট্টগ্রাম গোয়েন্দা পুলিশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করে আসা বাবুলের পরিচিতি ছিল জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার জন্য।

স্ত্রী খুন হওয়ার পর চট্টগ্রামে ফিরে বাবুল আক্তার বাদী হয়ে যে মামলা করেছিলেন, সেখানেও তিনি বলেছিলেন, তাঁর জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার কারণে খুন হয়ে থাকতে পারেন স্ত্রী। তবে এখন এই হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার বাবুলই ‘পরিকল্পিতভাবে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন’ বলে পুলিশি তদন্তে উঠে আসছে। মিতু হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল খুনিদের তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বাবুল আক্তার ও মাহমুদা খানম মিতু

মিতু হত্যায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে বুধবারই চট্টগ্রামে মামলা করেছেন তাঁর বাবা মোশাররফ হোসেন। ওই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবুলকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।

চট্টগ্রামে পুলিশ যখন বাবুল আক্তারকে নিয়ে তৎপর, সে সময় ঢাকার মেরাদিয়ার বাসায় মেয়ে হারানো বেদনার কথা জানান মিতুর মা সাহেদা মোশাররফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিতুর মুখেই প্রথম আমি মা ডাক শুনি। পাঁচ বছর হতে চলল, আমার মা নেই। কেউ ফোন দিয়ে বলে না, “মা, আমি ঢাকায় আসছি। বাসাটা গুছিয়ে রাখো।”’

বাবুল আক্তারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ দেন সাহেদা মোশাররফ।

তিনি জানান, তাঁদের দুই মেয়ে মাহমুদা খানম মিতু ও শায়লা খানম। বাবা মোশাররফ হোসেনের পুলিশে চাকরির সুবাদে দুই বোন মাহমুদা ও শায়লা নানা জেলায় পরিবারের সঙ্গে থেকেছেন। চাকরির সুবাদে পরিদর্শক মোশাররফের সঙ্গে পুলিশের আরেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল ওয়াদুদের পরিচয় হয়। এই ওয়াদুদের ছেলেই বাবুল আক্তার।

২০০১ সালে বাবুল যখন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী, তখন মাহমুদার সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পরও বাবুল আক্তার বেকার ছিলেন। প্রথমে চাকরি নেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। সেই চাকরি ছেড়ে আরেকটি ব্যাংকে চাকরি নেন বাবুল আক্তার। পরে কিছুদিন শ্বশুর মোশাররফ হোসেনের খিলগাঁওয়ের বাসায়ও থেকেছেন বাবুল।

সাহেদা মোশাররফ বলেন, ‘বিয়ের প্রথম দিকে বাবুলের সঙ্গে মিতুর সম্পর্ক ভালোই ছিল। আমার দুই মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। বাবুলকে নিজের ছেলের মতো করে দেখেছি। বিয়ের পর দিনের পর দিন বাবুল আমার বাসায় থেকেছে। চাকরির জন্য লেখাপড়া করেছে। বেকার বাবুলের ব্যাংকে চাকরি হয়েছে। সেই চাকরি থাকা অবস্থায় বাবুল বিসিএস দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হয়। এই যে বাবুল পুলিশ অফিসার হয়ে গেল, এরপর তার মধ্যে পরিবর্তন আসা শুরু হলো। আমার মেয়ে মিতুকে অবহেলা করত।’

মাহমুদা চট্টগ্রামে খুন হন ২০১৬ সালের ৫ জুন। ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা তাঁকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায়। বাবুল আক্তারের পরিকল্পনাতেই মিতুকে হত্যা করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন তাঁর বাবা মোশাররফ হোসেন।

মেয়েকে নিয়ে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মিতুর মা

মাহমুদার মা সাহেদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ে একদিন রাত ৩টার সময় ফোন দিয়ে বলেছিল, “মা, আমি কালই ঢাকায় চলে আসব।” তখন আমি মিতুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কী হয়েছে? মিতু তখন বলেছিল, কক্সবাজারের একটি হোটেলে একজন নারীর সঙ্গে বাবুলকে দেখেছে মিতু। বহুবার আমার মেয়ে আমাকে বলেছিল। শুধু দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে বাবুলের সঙ্গে সংসার করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়ে আর বাঁচতে পারল না। ওরা আমার নাতির সামনে আমার মেয়েকে খুন করে ফেলল।’

মাহমুদার মৃত্যুর প্রথম ছয় মাস বাবুল দুই সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। পরে ভাড়া বাসায় চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান দুই সন্তানও। গত সাড়ে তিন বছর ধরে মাহমুদার দুই সন্তানের সঙ্গে নানা-নানির দেখাই হয় না। মিতুর বড় ছেলের বয়স এখন ১২ বছর, মেয়ের ১০ বছর। সাহেদা বলেন, ‘আমার মেয়ের দুই সন্তানকে আমরা চোখের দেখাটাও দেখতে পাই না। ফোনেও কথা বলতে পারি না। অথচ মিতু বেঁচে থাকতে এই নাতি-নাতনির সঙ্গে রোজ আমার ফোনে কথা হতো।’

এদিকে বাবুল আক্তারের ভাই আইনজীবী হাবিবুর রহমান দাবি করেছেন, তাঁর ভাই স্ত্রী হত্যায় জড়িত নন। তিনি বলেছেন, বাবুল আক্তারের সঙ্গে তাঁর ভাবির ‘কোনো দাম্পত্য কলহ ছিল না’। বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে পরকীয়া প্রেমের যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা–ও সত্য নয়। ষড়যন্ত্র করে তাঁর ভাইকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।