>
- পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়েছে
- বাদ দেওয়া হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি
- আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর থেকে এই আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পক্ষ আপত্তি জানিয়ে আসছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করা হয়নি। তবে পুলিশের আপত্তিতে ‘মহাপরিচালকের অনুমোদন’ নেওয়ার বিধানটি এক দিনের মধ্যে বাদ দেওয়া হয়।
এভাবে শেষ মুহূর্তে সংশোধনীর ব্যাপারে জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার মতামতের পর আমাদের মনে হলো কোনো ঘটনা ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যদি পুলিশকে অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে সেই তদন্ত ব্যাহত হবে। অপরাধ করে অপরাধী তো আর বসে থাকবে না। সে কারণে এ অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন যেকোনো ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশের কারও অনুমতির দরকার পড়বে না। পুলিশ নিজেই ব্যবস্থা নিতে পারবে।’
পুলিশ বাহিনীর আপত্তির কারণে শেষ মুহূর্তে এই সংশোধনী কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশের কাজে ব্যাঘাত হবে বলেই পুলিশ এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানিয়েছে। আমরাও দেখেছি এটা করা দরকার।’
এতে ভারসাম্য নষ্ট হলো কি না বা পুলিশের একচ্ছত্র ক্ষমতা তৈরি হলো কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আইনে উল্লেখ আছে, পুলিশ কর্মকর্তা এটা তদন্ত করবেন। কর্মকর্তা থাকায় এর অপব্যবহারের ঝুঁকি একেবারেই থাকবে না।
গত বুধবার বিলটি উত্থাপনের পর বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তিনি ‘মহাপরিচালকের অনুমোদন’ নেওয়ার বিধানটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তাঁর এই প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয়। ফলে এখন তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশের কারও অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে কোনো স্থানে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে বা সাক্ষ্যপ্রমাণ হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হওয়ার বা করার সম্ভাবনা আছে, তাহলে তিনি ওই জায়গায় তল্লাশি চালাতে পারবেন। ঢুকতে বাধা পেলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তল্লাশির সময় অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দ করতে পারবেন। ওই স্থানে উপস্থিত যেকোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি করতে পারবেন এবং ওই জায়গায় কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ
করেছেন বা করছেন বলে সন্দেহ হলে ওই ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে।
কোন প্রেক্ষাপটে এই সংশোধনীর প্রস্তাব করেছেন, জানতে চাইলে ফখরুল ইমাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মহাপরিচালকের অনুমতি নিতে গেলে পুলিশের কাজে বাধা আসতে পারে। এ কারণে তিনি এই সংশোধনী প্রস্তাব করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি ধারার বিলুপ্তিও চেয়েছিলেন। ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট কেন এই আইনে যুক্ত করা হয়েছে, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
সূত্র জানায়, আইনটি বিল আকারে উপস্থাপনের পর পুলিশের একদল কর্মকর্তা আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের আপত্তির কথা জানান। পুলিশ কর্মকর্তারা তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রীকে বলেন, এই আইনে পুলিশের অধিকার খর্ব হবে। ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কারও অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকে, তাহলে জটিলতার সৃষ্টি হবে। পুলিশ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়ার ধারা থেকে মহাপরিচালকের অনুমতির অংশটুকু বাদ দিতে সুপারিশ করেন তাঁরা। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেন। এরপরই সংশোধনী আনা হয় বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সাইবার অপরাধের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমতি নেওয়া মানে একটা দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে যাওয়া। পুলিশ আদালতের কাছে দায়বদ্ধ থাকছেই, নতুন করে এজেন্সির মহাপরিচালক বা কোনো ব্যক্তির কাছে দায়বদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
পুলিশের হাতে এই আইনের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না, জানতে চাইলে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সাইবার অপরাধ তদন্ত যাঁরা করে থাকেন, তাঁরা প্রশিক্ষিত। সবাই এই তদন্ত করেন না। আর আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিলে পুলিশ সদর দপ্তর হস্তক্ষেপ করবে।
পুলিশ বলেছে, তারা এ আইন থেকে সাংবাদিকদের বাদ রাখার প্রস্তাব করেছিল। কারণ, অন্যদের অপরাধের সঙ্গে সাংবাদিকদের অপরাধ মেলে না। কিন্তু তাদের সে সুপারিশ মানা হয়নি।
মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন থেকে শুরু করে এ ধরনের সব বিতর্কিত আইনে পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা এ ধরনের আইন করেন। বিরোধী পক্ষের ক্ষেত্রেই এ ধরনের আইনের অপব্যবহার হয়ে থাকে। তাঁর মতে, পুলিশকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হলে প্রকটভাবে তা অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে।