পুরো পদ্মা সেতু ২০২০ সালের জুনে

জাজিরায় পদ্মাসেতুর সপ্তম স্প্যান বসানোর আগমুহূর্তে। মাওয়া ঘাট এলাকা, ২৩ জানুয়ারি। ছবি: কমল জোহা খান
জাজিরায় পদ্মাসেতুর সপ্তম স্প্যান বসানোর আগমুহূর্তে। মাওয়া ঘাট এলাকা, ২৩ জানুয়ারি। ছবি: কমল জোহা খান

এলাকাটি একেবারে প্রমত্তা পদ্মা নদীর কূলে। নাম শরীয়তপুরের নাওডোবা। নদীর এই পাড়ে ইঞ্জিনের ছোট্ট ট্রলারে বসে গতকাল বুধবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ভাত খাচ্ছিলেন আনোয়ার হাওলাদার। বয়স পঞ্চাশের মতো। এক লোকমা করে ভাত মুখে দিচ্ছেন, আর কিছুক্ষণ পরপর ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকাচ্ছেন। দৃষ্টি নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান অংশের ওপর। মাত্র এক ঘণ্টা আগেই সেতুর ওই অংশে ১৫০ মিটার দীর্ঘ একটি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।

বারবার পেছনে তাকান কেন? সেতু হলে কি নৌকার ব্যবসায় বাগড়া পড়বে? মন খারাপ?

এ প্রশ্নে রেগে গেলেন আনোয়ার। তিনি বললেন, ‘মন খারাপ হইব কেন? সেতু হইলে লাভ হইব। এইটা আমাগো জাতীয় সম্পদ।’

একটু থেমে আনোয়ার বলেন, ‘আমাগো নাও চালানো বন্ধ হইব না। ব্রিজ দিয়া বাস চলব। আর নাও দিয়া গ্রামে গ্রামে লোক পার করমু। নাও চালান বন্ধ হইব না।’

সেতুর কাজের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করলেন আনোয়ার। বললেন, ‘ইনশা আল্লাহ কাম যখন শুরু হইছে, শেষও হইব।’

আনোয়ারের মতো পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

৩৭ ও ৩৬ নম্বর পিলারের (খুঁটি) ওপর গতকাল স্প্যান বসানোর পর প্রকল্পের এক উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নকশার জটিলতা কেটে গেছে। এখন আশা করছি, ২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে।’

৩৬ ও ৩৫ নম্বর পিলারে আরও একটি স্প্যান ফেব্রুয়ারি মাসে বসানো হতে পারে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এখন আর পদ্মা সেতু নিয়ে বড় কোনো সমস্যা নেই। সব পিলারের নকশা ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন কাজ হলো নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করা। আশা করা যায়, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন করা যাবে।

সরেজমিনে মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের সামনে আরও স্প্যান প্রস্তুত করে রাখতে দেখা গেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, আরও পাঁচটি স্প্যানের ৯০ শতাংশ প্রস্তুতের কাজ শেষ হয়েছে। জানুয়ারির মধ্যে এসব স্প্যান প্রস্তুত হয়ে যাবে। এই স্প্যানগুলো আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বসানো হবে। তবে আপাতত জাজিরা প্রান্ত থেকে স্প্যান বসানোর কাজ চলবে। ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় মাওয়া প্রান্তে স্প্যান আপাতত বসানো হচ্ছে না। এই দুটি পিলারের কাজ শেষ হলে মাওয়ায় স্প্যান বসানো শুরু হবে। তবে মাঝনদীতে ১২ ও ১৩ নম্বর পিলার দুটি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এরপর ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয় দ্বিতীয় স্প্যান। গত বছরের ১১ মার্চ ৩৯ ও ৪০ নম্বর খুঁটির ওপর বসে তৃতীয় স্প্যান। ১৩ মে ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটির ওপর চতুর্থ স্প্যান বসানো হয়। সবশেষ ২৯ জুন সেতুর পঞ্চম স্প্যান বসানো হয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকায়। জাজিরা প্রান্তের তীরের দিকের এটিই শেষ স্প্যান। এর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর ৭৫০ মিটার একসঙ্গে দৃশ্যমান হয়।

এ ছাড়া মাওয়া প্রান্তে ৪ ও ৫ নম্বর পিলারের ওপর ষষ্ঠ স্প্যান বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে পদ্মা নদীতে মোট সাতটি স্প্যান এ পর্যন্ত বসানো হয়েছে।

দ্বিতল পদ্মা সেতু হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটি প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। খুঁটির ওপর ইস্পাতের যে স্প্যান বসানো হবে, এর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। পুরো সেতুতে মোট পিলারের সংখ্যা ৪২। প্রতিটি পিলারের রাখা হয়েছিল ছয়টি পাইল। একটি থেকে আরেকটি পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। এই দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মিত হবে। ৪২টি খুঁটির ওপর এ রকম ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। স্প্যানের অংশগুলো চীন থেকে তৈরি করে সমুদ্রপথে জাহাজে করে আনা হয় বাংলাদেশে। ফিটিং করা হয় মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে। তবে কাদামাটির পরই শক্ত মাটি না পাওয়ায় পদ্মা সেতুর ১৪টি পিলারের মধ্যে ১টি করে পাইলের সংখ্যা বাড়ানো হয়। গত সপ্তাহে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নকশা চূড়ান্ত করা হয়।

পদ্মা নদীতে ট্রলার চালিয়ে চলে আনোয়ার হাওলাদারের জীবন। প্রমত্তা নদীর ওপর গড়ে উঠছে স্বপ্নের এই সেতু। পেশা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও আনোয়ার মনেপ্রাণে চাইছেন, যেন শেষ হয় সেতুর নির্মাণকাজ। ছবি : শুভ্র কান্তি দাশ

সেতুর নকশা–জটিলতা কাটানোর পর বৃহৎ এই প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৬ ও ৭ নম্বর পিলারের পাইল বসানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। তাই বলা যেতে পারে, পদ্মা সেতুর বড় সমস্যা আমরা ওভারকাম করেছি। বড় কোনো সমস্যা আর নেই।’

স্প্যানের মতো পিলার নির্মাণের কাজও বেশ দ্রুত চলছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মূল নদীতে ৪০টি পিলার রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি পিলারের নির্মাণকাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ১৪টি পিলারের কাজ আগামী মার্চ মাসের শেষে সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে। বাকি ১১টি পিলারের পাইল ড্রাইভের কাজ চলছে।

পিলার ও স্প্যানের পাশাপাশি সেতুতে রেলপথের জন্য স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। দুটি রেলওয়ের স্ল্যাব বসানো হয়ে গেছে। এ মাসেই শুরু হবে ২২ মিটার প্রস্থের রোড ওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতুর সার্বিক অগ্রগতি ৬৩ শতাংশ। পদ্মা সেতুর বিভিন্ন অংশের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল সেতুর অগ্রগতি ৭৩ শতাংশ, নদীশাসনের কাজের অগ্রগতি ৫০ ভাগ। ২৬১টি পাইলের মধ্যে ১৯১টি পাইলের কাজ শেষ হয়েছে। আরও ১৫টি পাইলের আংশিক কাজ শেষ হয়েছে। ১৬টি পিলারের কাজ পুরোপুরি শেষ। আরও ১৫টি পিলারের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত ছয়টি স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। ফলে, এখন সেতুর ৯০০ মিটার দৃশ্যমান। প্রস্তুত রাখা আছে আরও ১৭টি স্প্যান।

বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। বর্তমান ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুই প্রান্তে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক, অবকাঠামো নির্মাণ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

আরও পড়ুন...