পুরোনো মানচিত্রে যুদ্ধ করেছিলেন নিয়াজি

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে হানাদার বাহিনীর ব্যবহার করা বাংলাদেশের মানচিত্র। প্রথম আলো
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে হানাদার বাহিনীর ব্যবহার করা বাংলাদেশের মানচিত্র।  প্রথম আলো

যুদ্ধে মানচিত্র অপরিহার্য। জেনারেলরা যুদ্ধের পরিকল্পনায়, যুদ্ধ পরিচালনায় মানচিত্র ব্যবহার করেন। এগুলোকে ‘ওয়ার ম্যাপ’ বলে। শত্রুপক্ষের মানচিত্র সামনে রেখে তাঁরা যুদ্ধের কৌশল ফাঁদেন। জেনারেলরা মানচিত্র ধরে সেনাবহর পাঠান, আক্রমণ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জেনারেলরাও মানচিত্র ব্যবহার করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে মানচিত্র ব্যবহার করেছিলেন, তা ছিল ১২ বছরের পুরোনো। বিশালকায় মানচিত্রটি এখন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।

জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর দিনপঞ্জিও দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করেছে। দিনপঞ্জিটি জাদুঘরের গ্যালারি-১-এ রাখা আছে। মুনীর চৌধুরী এটি লিখেছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে। সেটি ১৯৪৯ সালের কথা। জাদুঘরের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী ও তাঁর ছেলে আসিফ মুনীর চৌধুরী এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি সেই দিনপঞ্জিটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করেছেন।

ছোট একটি কাচের বাক্সে রাখা দিনপঞ্জির প্রথম পাতাটি আগ্রহী ব্যক্তিদের পড়ার সুযোগ আছে। ১ জুন ১৯৪৯ সালে দিনপঞ্জি লেখা শুরু করেন মুনীর চৌধুরী। দিনপঞ্জিটি শুরু হয়েছে এভাবে: ‘৯ মার্চ গ্রেপ্তার করেছে। সেই থেকেই এখানে। আর এক হপ্তা পর পুরো তিন মাস হবে।...।’ এই গুরুত্বপূর্ণ দিনপঞ্জির পাশে মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত কবর নাটকের দুটি চরিত্রের এফএসপি (ফ্রি স্ট্যান্ডিং পিউপিল) তৈরি করা হয়েছে। প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশন মুনীর চৌধুরীর এই দিনপঞ্জির সঙ্গে লিলি চৌধুরীর লেখা দিনপঞ্জি যুক্ত করে দিনপঞ্জি-মনপঞ্জি-ডাকঘর নামে ২০৭ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলির মুখে পড়েছিলেন। কোমরে থাকা পিস্তল তাঁর জীবন রক্ষা করে। পাকিস্তানি সেনার গুলি পিস্তলে লেগেছিল। জীবন রক্ষাকারী পিস্তলটি সফিউল্লাহ জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে দান করেছেন। কর্তৃপক্ষ এ বছরের কোনো একসময় পিস্তলটি দর্শকদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করবে। মুক্তিযুদ্ধের আরও কিছু দান করা স্মারক উন্মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।

নিয়াজির যুদ্ধ মানচিত্রটি জাদুঘরের চতুর্থ তলায় রাখা হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুরে সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়ানির আরাফাত ও জান্নাতুল ফেরদৌসী মানচিত্র দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলেন এর কোথায় কী আছে। বাংলাদেশের এত বড় মানচিত্র তাঁরা আগে দেখেননি বলে প্রথম আলোকে বলেন।

জাদুঘর কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি মানচিত্রটিকে ‘অপারেশনাল ম্যাপ’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়াজির বাংকার থেকে মানচিত্রটি উদ্ধার করে। যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনী মানচিত্রটি নিয়ে যায়নি। মানচিত্রটি ভারতীয় হাইকমিশনে ছিল। ভারতীয় হাইকমিশনার দেব মুখার্জি মানচিত্রটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্যসচিব জিয়াউদ্দিন তারিক আলী প্রথম আলোকে বলেন, ভাগ্যক্রমে মানচিত্রটি ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে যায়নি। মানচিত্রটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালিত হতো এই মানচিত্র অনুযায়ী। তিনি বলেন, ‘মানচিত্রটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে দেশের প্রতিটি মৌজা চিহ্নিত করা আছে।’ মানচিত্রে কিছু পোকায় কাটা দাগ আছে। জিয়াউদ্দিন তারিক আলী বলেন, জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এভাবেই ভারতীয় হাইকমিশনের কাছ থেকে পেয়েছিল।

মানচিত্রটি ১০ ফুটের মতো লম্বা। এর স্কেল: এক ইঞ্চি সমান চার মাইল। ভাষা ইংরেজি। মানচিত্রে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ শহর-বন্দর ছাড়াও মৌজার উল্লেখ আছে। এতে কিছু সংকেত ব্যবহৃত হয়েছিল। যেমন: সিলেট এলাকায় ইংরেজি বড় হরফে আরসি, আরএইচ। খুলনা-যশোর এলাকায় কিউওয়াই, কিউইউ, কিউজেড। আবার ঢাকার জন্য আরএল। এসব সংকেতের অর্থ উদ্ধার করা যায়নি। পাকিস্তানি সমরপ্রধান তাঁর সেনা দপ্তরে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনার কাজে এটি ব্যবহার করতেন। মানচিত্রটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ব্যবহৃত হলেও এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৫৯ সালে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধরে রাখার একটি নাগরিক উদ্যোগ। একটি ট্রাস্টি বোর্ড এটি পরিচালনা করে। ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ রাজধানীর সেগুনবাগিচার একটি ভাড়া বাড়িতে এর যাত্রা শুরু হয়। ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল আগারগাঁওয়ের নিজস্ব ভবনে জাদুঘর স্থানান্তরিত হয়। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এতে সরকারের অনুদান আছে। দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত ২৫ হাজারের বেশি স্মারক সংগ্রহ করেছে। স্মারক সংগ্রহ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের মৌখিক ভাষ্য সংগ্রহ, ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের স্মারক প্রদর্শনী, ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ প্রদান করা হয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত দিবসগুলো সাড়ম্বরে পালনের পাশাপাশি গণহত্যা বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজকে যুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ে জানানো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি বড় কাজ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বড় গ্রন্থাগার জাদুঘর ভবনে।