ডিএনএ পরীক্ষায় বিভ্রান্তি

পুরুষের লাশ হয়ে গেল নারী

  • হাসপাতালে মরদেহ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজটি করেন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী।

  • পুলিশের অভিযোগ, হাসপাতালে অদক্ষ জনবল দিয়ে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করায় এমন হচ্ছে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে যমুনা নদী থেকে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তির অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে পাঠায় সিরাজগঞ্জের সদর থানার পুলিশ। লাশ শনাক্তে ডিএনএর নমুনা সংরক্ষণের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে পুলিশ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া নমুনা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবরেটরিতে (ডিএনএ ব্যাংক) পাঠায় জেলা পুলিশ। কিছুদিন পরে ডিএনএ ল্যাবরেটরি থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয় লাশটি একজন নারীর। অথচ বাহ্যিক সব রকম শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী লাশটিকে ‘পুরুষ’ হিসেবেই মামলার সব কাগজে উল্লেখ করে পুলিশ। এ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিলে একাধিকবার ডিএনএ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। প্রতিবারই তা নারীর বলে প্রতিবেদন আসে। এ বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ জানিয়েছে, এ রকম চারটি লাশের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষায় পাঠিয়ে বিপাকে পড়েছে তারা। বিঘ্নিত হচ্ছে মামলার তদন্ত।

পুলিশের অভিযোগ, সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে অদক্ষ জনবল দিয়ে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করায় এমনটি হচ্ছে। অভিযোগ তদন্তে কমিটি করেছে জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

চারটি লাশের ডিএনএ পরীক্ষায় এ রকম গড়বড় হয়েছে। পুলিশের ধারণা, সমস্যাটা নমুনা সংগ্রহে। তদন্তে কমিটি করেছে হাসপাতাল।

পুলিশ জানায়, উল্লাপাড়া থানা এলাকায় গত বছরের ডিসেম্বরে ফুলজোর নদ থেকে উদ্ধার করা হয় এক ব্যক্তির মরদেহ। সুরতহাল প্রতিবেদনেও লাশটিকে পুরুষ বলে উল্লেখ করা হয়। সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মাধ্যমে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের পর তা পাঠানো হয় ঢাকায়। সিআইডির ডিএনএ ব্যাংকে একাধিকবার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। প্রতিবারই সেটি এক নবজাতক কন্যাশিশুর বলে প্রতিবেদন আসে।

উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক কুমার বলেন, গত বছরের ১১ জুলাই সরাবিল এলাকা থেকে অর্ধগলিত মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। পোশাক ও অন্যান্য বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে তা একটি পুরুষের বলে নিশ্চিত করে পুলিশ। এর মধ্যে সলঙ্গা থানার চরগোজা গ্রামের গৃহবধূ সেলিনা খাতুন মরদেহটি তার স্বামীর বলে দাবি করেন। তবু পরিচয় নিশ্চিতের জন্য হাসপাতালের মাধ্যমে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় ঢাকায়। একই সঙ্গে পাঠানো হয় ওই নারীর সাত বছরের যমজ দুই ছেলের নমুনাও। প্রতিবেদনে বলা হয় মরদেহটি এক কন্যাশিশুর।

ওসি বলেন, এরপর আবারও ওই মরদেহের ডিএনএ নমুনা ঢাকায় পাঠানোর জন্য জেনারেল হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে হাসপাতাল জানায়, মরদেহের নমুনা নষ্ট হয়ে গেছে। পুলিশ বাধ্য হয়ে আদালতের অনুমতি নিয়ে কবর থেকে ওই মরদেহ তুলে আবার ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে।

একই রকম ঘটনা ঘটেছে বেলকুচি থানার এক কিশোরীর লাশ শনাক্তের ক্ষেত্রেও। বেলকুচি থানার ওসি গোলাম মোস্তফা বলেন, গত বছরের ১ জুলাই মৃত এক কিশোরীকে নিজের সন্তান দাবি করে থানায় লিখিত দেন লালচান শেখ ও পারভিন খাতুন দম্পতি। বিষয়টি নিশ্চিত করতে পুলিশ হাসপাতালের মাধ্যমে মরদেহের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠায়। সেই সঙ্গে লালচান ও পারভিনেরও নমুনাও পাঠাতে বলা হয়। এরপর প্রথম দফায় প্রাপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মরদেহটি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে পুলিশ নিহত কিশোরীর মাথার খুলি, পাঁজরের হাড়, দাঁত ও চুল কবর থেকে সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠায়। একই সঙ্গে লালচান ও পারভিনের ডিএনএ নতুন করে সংগ্রহ করে পাঠানো হয়। কিন্তু সে সময় এই দম্পতির নমুনা সঠিকভাবে সংগ্রহ হয়নি বলে ফেরত পাঠানো হয়। এসব কারণে এ ঘটনার তদন্তকাজে পুলিশের দেরি হচ্ছে।

এ নিয়ে জেলার পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নমুনা দেওয়ার পর আলামতের সঙ্গে চারটি ঘটনার গরমিল পাওয়া গেছে। এ রকম ঘটনার কারণে তদন্তে সময় বেশি লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এতে মামলা দুর্বল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। আবার পুলিশের কর্মকর্তাদেরও একটি বিষয় নিয়ে বারবার দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, মরদেহ থেকে ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করেন সেখানকার পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সুইপার) রানা হরিজন। তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে কোনো ডোম নেই। যে কারণে তাঁকে দিয়েই ডোমের কাজ করানো হয়। চিকিৎসকেরা কখনোই মরদেহ স্পর্শ করেন না। তাঁকে একাই সব করতে হয় বলে দাবি তাঁর। যে কারণে অতিরিক্ত কাজের চাপে কখনো ভুল হলেও হতে পারে।

রানার অভিযোগ স্বীকার করে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ফরিদুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে ডোমের পদ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে পদটি খালি। কোনো নিয়োগ নেই। ডোমের জন্য একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলেও পদটি এখনো খালি পড়ে আছে। এ কারণে সুইপারকে দিয়ে ডোমের কাজ চালাতে হচ্ছে।

তবে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রানা হরিজনের ভুল হওয়ার কথা না। কারণ, সুইপার হলেও বাবার কাছ থেকে তিনি ডোমের কাজ শিখেছেন। তাঁর বাবা এখানে ডোম ছিলেন। জনবল না থাকায় বাধ্য হয়ে তাঁকে দিয়েই ডোমের কাজ চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ডিএনএ নমুনা নিয়ে কোথায় গলদ হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ (আরএমও) তিনজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বিষয়টি তদন্ত করে জানাবেন।