>ভয়কে জয়ের সাহস আছে তাঁদের, তাঁরা অদম্য। বাঁধা পেরোনো অদম্য মেধাবীর গল্প
চট্টগ্রাম শহর থেকে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় যেতে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা। সেখান থেকে বর্নাল ইউনিয়নের থোয়াইহ্লাপাড়া গ্রাম ভাড়ার মোটরসাইকেলে আরও দুই ঘণ্টার পথ। দুর্গম থোয়াইহ্লাপাড়া মারমা-অধ্যুষিত। স্থানীয় বাঙালিরা বলে থৈলাপাড়া। সেখানে প্রায় ৮০টি মারমা পরিবার। লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকা গ্রামটিতে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী হাতে গোনা। তাঁদের একজন অংথোয়াইচিং মারমা। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং (পিএমই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
থোয়াইহ্লাপাড়ার একটা ছেলে কী করে চুয়েটে পড়ার সুযোগ পেলেন? অং এ প্রশ্নের উত্তরে লাজুক হেসে তাকিয়ে থাকেন। মৃদুস্বরে বলেন, ‘এ এমন কী আর! এ দেশের বহু গ্রামের ছেলেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।’ আলাপে আলাপে তারপর জানা হয়ে যায় তাঁর শৈশব, কৈশোর আর তরুণ বয়সের গল্প।
১৯৯৬ সালে জন্ম অংয়ের। লেখাপড়ার শুরু গ্রামের থৈলাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ভর্তি হন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমের মনোবংকুল দম্মাপিয়া স্কুলে। মারমাদের একটা আশ্রম স্কুলটা চালাত। সেখানে তিন বছর পড়ে অং আবার চলে আসেন থৈলাপাড়া স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিয়ে পান জিপিএ-৫। তাঁর আগে ও পরে ওই স্কুলে পিএসসিতে আর কেউ জিপিএ-৫ পায়নি। ২০০৭ সালে গ্রাম ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন খাগড়াছড়ি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের ফার্স্ট বয় হলেও জেএসসি পরীক্ষার জিপিএ-৫ পেলেন না।
২০০৯ সালে ভর্তি হলেন খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। স্কুলটিতে পড়ে জেলার সবচেয়ে মেধাবীরা। এখান থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেন মাধ্যমিক। ভালো ফল করায় এক শিক্ষক ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হতে পরামর্শ দিলেন। নটর ডেম থেকে ২০১৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ অর্থাৎ গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে পাস করলেন অং। পরের গল্পটা বহু পাঠকের জানা।
পরিবারের পাশাপাশি অংথোয়াইয়ের লেখাপড়ার খরচের একটা বড় অংশ এসেছে বৃত্তির টাকা থেকে। মাধ্যমিকের পর থেকে প্রথম আলো ট্রাস্টও লেখাপড়ায় তাঁকে সহযোগিতা দিচ্ছে। তবে এসব সহযোগিতা কাজেই আসত না, যদি অং হাল ছেড়ে দিতেন। হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো বহু পরিস্থিতিই তো তাঁর সামনে এসেছে।
অংথোয়াইচিংয়ের বাবা ম্রাসাথোয়াই (৬০) মারমা বৌদ্ধভিক্ষু বা ভান্তের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। অং বাবাকে কখনো ঘরে দেখেননি। তিনি থাকতেন পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে একটি কিয়াংয়ে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে অং সবার ছোট। তাঁর এত দূর আসার পেছনে কারও কথা বলতে হলে অং প্রথমেই বলবেন মায়ের কথা। শৈশবের দিকে তাকালে অং আজও দেখতে পান, পাহাড়ের পাশে ছোট্ট কুটির। সেখানে বোন আনুমা আর তাঁকে নিয়ে মায়ের অক্লান্ত যুদ্ধ।
বাবা তাঁদের দেখতে আসতেন, খোঁজখবরও নিতেন। যতটা পেরেছেন লেখাপড়ার খরচও জুগিয়েছেন। কিন্তু ঘরে থাকেননি কখনো। একজন ভান্তে সন্তান ও পরিবারের খোঁজ নেয়, এটা নিয়মের বাইরে। তবু বাবা সাধ্যমতো সাহায্য করতেন।
অংদের ছোট্ট কুটিরে অন্ধকার নামত সন্ধ্যার আগেই। পড়তে বসতে হতো কুপির কাঁপা আলোয়। মাকে একাই সব সামলাতে হতো। রান্না, জুমের কাজ, পানি আর জ্বালানির জন্য লাকড়ি জোগাড়—সবই। সংসার চালানোর জন্য রাস্তা সারাইয়ের কাজও নিয়েছিলেন। মায়ের কাছে শুনেছেন, সন্তানকে পিঠে বেঁধে বহন করতেন রাস্তার জন্য ইট-বালু।
বলতে বলতে অংথোয়াইচিংয়ের চোখ ছলছল করে ওঠে। সামলে নিয়ে বলেন, ‘কিন্তু এসবের কোনো প্রতিদান আমি দিতে পারিনি।’ একটু পরে বোঝা গেল, কিছু করতে পারা মানে, মানুষের জন্য কিছু করার কথা বলছেন অং। তাঁর স্বপ্ন স্নাতকের পর উচ্চতর গবেষণা। তারপর এ দেশের মানুষের জন্য কিছু করা।
সে ইচ্ছা থেকেই গ্রামের তরুণদের নিয়ে শুরু করেছেন শিক্ষার আন্দোলন। প্রতিষ্ঠা করেছেন পঞঞারাং নামে পাঠাগার। পঞঞারাংয়ের অর্থ শিক্ষার আলো। সেই আলো ছড়িয়ে দিতে অং ১৫ জন তরুণ নিয়ে একটি দল গড়েছেন। ছুটিতে বাড়ি গেলে তাদের নিয়ে বিনা মূল্যে সব বয়সী ছেলেমেয়েকে পড়ান তাঁরা। পাঠাগারটির কথা বলতে বলতে অংয়ের উচ্ছ্বাসের কোনো সীমা থাকে না।
আহমেদ মুনির: কবি ও কথাসাহিত্যিক; সাংবাদিক।