গানের সুরে সুরে সমস্ত ক্লান্তি ভুলে গ্রামের মেঠোপথ ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে নতুন বউকে শ্বশুরালয়ে নিয়ে যেতেন যাঁরা, তাঁরা বেহারা। দুলিয়ে দুলিয়ে, মা-বাবার মায়া ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট ভুলিয়ে স্বামীর সংসারে পৌঁছে দেওয়ার বাহনটি পালকি। এটিকে প্রথমত মনে করা হতো দেবতার বাহন। পরবর্তীকালে ইউরোপের সম্ভ্রান্ত নারীদের বাহন হিসেবে পরিচিতি পায়। কালের পরিক্রমায় উপমহাদেশে সম্ভ্রান্ত মহলে এটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তা ক্রমেই আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। যার ফলে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে পালকির একটি বিশেষ অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
পালকি কেন এবং কোন কারণে বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যে বিশেষ অবস্থান করে নিয়েছে, সে উত্তর একটু খোঁজা যাক। প্রথমত, এই পালকির গঠন এবং পালকি তৈরির উপকরণ বিশ্লেষণ করতে চাই। পালকি এমন একটি বাহন, যেটি তৈরি করা যায় খুব সহজে। অত্যন্ত আরাম-আয়েশে বসা যায় বা আধশোয়া অবস্থায় থাকা যায়, এমন উচ্চতা রেখে দৈর্ঘ্য আর প্রস্থে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে চৌকোনা আকৃতির এ বাহন তৈরি করা হয়। এটি তৈরির মূল উপকরণ কাঠ, যা আমাদের দেশে খুবই সহজলভ্য। এ বাহনের দুই পাশে দুটি শক্ত ও মোটা খুঁটি সামনে আর পেছনের দিকে প্রলম্বিত করে স্থাপনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়, যা দুই, চার, কিংবা ছয়জন বেহারা কাঁধে নিয়ে খুব সহজেই চলতে পারেন। নির্মাণকৌশল খুব সহজ ও নির্মাণের উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় আমাদের দেশে এটি ক্রমেই সহজলভ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এটি আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে যখন এর ব্যবহার সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে বর-কনের নান্দনিক বাহনে পরিণত হয়। একই সঙ্গে এই বাহনের বেহারাদের ক্লান্তি দূর করার জন্য তাঁদের মুখে মুখে যখন বিশেষ ধরনের সংগীতের সৃষ্টি হয়, তখন তা সাধারণ জনমানুষের মনের আরও গভীরে স্থান পেতে শুরু করে। সংগত কারণেই পালকি নিয়ে যখনই বেহারারা গ্রামের রাস্তায় হেঁটে যেতেন, রাস্তার দুপাশে অত্যন্ত আগ্রহ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, শিশু-কিশোরের ভিড় জমে যেত। আর কান পেতে শুনতে থাকত বেহারাদের হৃদয়দোলানো গানের ব্যঞ্জনা।
এমন কী থাকত বেহারাদের এই গানে? বিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়। বেহারারা যে ভাষায় গান গাইতেন, তার ভাষাশৈলী অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল। গানের শব্দমালা প্রতিদিনের জীবনযাপন থেকে নেওয়া। কথামালা ছিল আপনার–আমার মুখের কথার মতো, কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত সুনিপুণ ছন্দোবদ্ধ এবং মাত্রাবিন্যাসে ছিল অত্যন্ত যত্নশীল, যা তাঁদের অবচেতন মনে হয়ে যেত। অনেকটা চারণ কবির মুখের চরণের মতো খই ফুটত, যখন তাঁরা নতুন বউ কিংবা বরকে নিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতেন। গানে গানে উঠে আসত কনের রূপের বর্ণনা, সাজপোশাকের বিবরণ অথবা বরের বীরত্ব কিংবা নানান যোগ্যতা।
‘কর্তাবাবুর রংটি কালো, গিন্নিমায়ের মনটি ভালো, সামলে চলো হেঁইও
হেঁইও জোয়ান সরু আল চলো ধীরে, কর্তাবাবুর দরাজ দিল দেবে চিড়ে’
বাঙালির বিয়ের আয়োজনের অন্যতম একটি পর্ব মেহেদি তোলা। এই মেহেদি তোলার প্রতিটি দৃশ্যের বর্ণনা উঠে আসত বেহারাদের সুরে…
‘ছিল মেন্দি হিন্দুস্তানে, আইলো মোন্দি পাকিস্তানে
এই মোন্দি তুলিবো কে? দুলাইনের বড় ভাবি রে...’
সামান্য বকশিশের আশায় নতুন বউ নিয়ে তাঁরা বরের বাড়ির প্রতিটি ঘরের দরজায় গিয়ে গিয়ে সুরে সুরে গান গাইতেন সেই ঘরের গৃহকর্তা কিংবা গৃহিণীর মনোরঞ্জনের জন্য।
‘এই ঘরের বড় ভাবী কোথায় জানি গেল রে...
মান দেওয়ার ভয়ে ভাবী কোথায় জানি পালাইলো...’
ছেলের মাকে খুশি করার জন্য বরের বাড়ির নিকটবর্তী হলে বেয়ারারা ধরতেন নতুন গান—
‘আল্লা বোল, ওরো বোল, মাইয়ার মারে দিসি গোল...
পোলার মারে স্বর্গে তোল’
‘যেই কোদালে ছাঁচে হিসে দুলার বাপের বাড়ি রে,
সেই কোদালে ছাঁচে দুলহানের বাপের দাড়ি রে’
আবার বেহারারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল গান ধরত কনের পক্ষে, অন্য পক্ষ গান ধরত বরের পক্ষে। বাড়ির আঙিনায় ভিড় করে গ্রামের সব মানুষ প্রাণভরে শুনত বেহারাদের গান। শুধু যে তাঁদের গানে বর-কনের বিষয়াদি ছিল, তা নয়; গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরুর গৃহস্থের দিনযাপনের চিত্র চিত্রিত হতো বেহারাদের গানে গানে...
‘বাঁইশ ভরি রাখছি ধান চিড়া খাইবার আশে
সেই ধান কাটিয়া নিল রাজবাড়ির ইঁদুরে রে...
হরি হরি রে, বাইচ্চা ইঁদুরে ঘিরিল আমার বাড়ি রে...’
গৃহস্থালির দিনযাপনের পাশাপাশি পালকির গান ছিল রোমান্টিসিজমে ভরপুর। হৃদয়নিংড়ানো সুরে, মনদোলানো কথামালায় বেহারারা মাতিয়ে তুলতেন প্রেমিক-প্রেমিকার মন...
‘হাতে যদি তুলি ফুল, হাতের ময়লা লাগে রে
কোলে যদি তুলি ফুল, ফুলের রেণু ঝরে রে
মাথায় যদি তুলি ফুল, চিলে ছোঁপ্পা দেয়ো রে...
ও ফুল ভ্রমরা রে...
কারে দি পাঠাইব ফুল, সুন্দীরর মান্দিরে,
ও ফুল ভ্রমরা রে...’
সামাজিকভাবে বাঙালি সংস্কৃতিতে কনেকে বিয়ে দেওয়ার পর বরের বাড়িতে চলে যায়। নিজের মেয়েকে জন্মদানের পর থেকে অতি আদরে লালনপালনের পর যখন পরের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, তখন মেয়ের মা-বাবার হৃদয়ের ভেতরে শুরু হয় বিচ্ছেদের রক্তক্ষরণ। আর সেই বিষয়ও বাদ ছিল না পালকির গানে।
‘আগে যদি জাইনতাম বালি (মেয়ে), পরে নিবো তোরে রে
হাতের কাম ফালাই রাখি কোলে নিতাম তোরে রে
আগে যদি জাইনতাম বালি (মেয়ে), পরে নিবো তোরে রে
চুলার আগুন নিভাই রাখি কোলে নিতাম তোরে রে’
মেয়েটি হৃদয়ও যে তার মা-বাবার জন্য সব সময় হাহাকার করে বেড়াত, সারা দিনমান দূরের আকাশে প্রতীক্ষার নজরে খুঁজে বেড়াত বাবার বাড়ি থেকে তাঁকে দেখার জন্য, নাইওর নেওয়ার জন্য কেউ আসছে কি না? এমনও দৃশ্যকল্প ফুটে উঠত পালকির গানে...
‘ওই দেখা যায় ঘরের পিছ দি, রেল গাড়ি আইতাছে,
রেলের কপাট খুইলা দেখো, বাজান বাইয়া রইছে
ও বাজান বাজান গো, মায়ে কিতা করে
আমার মায়ের কঁন্দনে বৃক্ষের পাতা ঝরে’
এককথায় বলা চলে, চলমান জীবনের গতিধারা ক্লান্তিময় দীর্ঘ হেঁটে চলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে যখন সুরের মূর্ছনায় উচ্চারিত হয়, তখন তা খুব সহজেই মানুষের মনে নিজের জন্য এমন একটি জায়গা করে নেয়, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে যেতে থাকে নববধূর ভেজা চুলের ঘ্রাণ।
পালকির গানের কথা ও সুর সাধারণ জনমানুষের মনে গেঁথে যাওয়ার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম তার উপকরণ, সহজবোধ্যতা, সাবলীল উচ্চারণ, হৃদয়দোলানো সুর, বেহারাদের উপস্থাপন এবং চমৎকার চিত্রকল্প। গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি বিষয় অত্যন্ত নান্দনিক উপস্থাপনায়, নেচে-গেয়ে চিত্রকল্পগুলো চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলার অসম্ভব ক্ষমতার কারণে লোকসাহিত্যে তার একটি শক্ত অবস্থানের সৃষ্টি হয়। আর সে জন্যই ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পালকি নিয়ে জাদুকরি শব্দচয়নে রচনা করেন বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা ‘পালকির গান’—
‘পালকি চলে/ পালকি চলে/ গগন তলে/ আগুন জ্বলে/ স্তব্ধ গাঁয়ে/ আদুল গায়ে/ যাচ্ছে কারা/ রৌদ্রে সারা’
পালকির প্রভাব আমাদের লোকসাহিত্যে এতটাই প্রকট যে ‘পালকির গান’ কবিতাটা একসময় সুরসম্রাট সলিল চৌধুরীর সুরে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গাইতে শোনা যায়, যা এখনো বাংলা ভাষার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি।
এ ছাড়া বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতায়ও উঠে এসেছে পালকির কথা...
‘তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে/ দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে’
পালকি ধীরে ধীরে বাঙালির মনে এমন একটি আবেদন সৃষ্টি করেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালে দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর পরিচালনায় নির্মিত হয় জনপ্রিয় ছবি ‘পালকি’। তা ছাড়া বাংলা নাটক, উপন্যাস ও গল্প-কবিতায় বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে পালকি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
তা ছাড়া কাঠের তৈরি এই পালকির বাইরের দেয়ালে খোদাই করে আঁকা হতো আবহমান বাঙলার লোকগাথা। নকশিকাঁথায় যেমন গ্রামবাংলার প্রকৃতি, গ্রামীণ দৃশ্যপট, গ্রামীণ জীবন যাপনের চিত্রকল্প সুইয়ের আলপনায় আঁকা হতো, পালকির গায়েও ঠিক তেমনি আমাদের লোকজ জীবন যাপনের বিভিন্ন দৃশ্যপট, প্রকৃতির সাবলীল উপস্থিতি পাওয়া যেত। আর তার ফলেই পালকি দিনে দিনে আমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম একটি উপাদান হয়ে ওঠে এবং কালের পরিক্রমায় লোকসাহিত্যে তার একটি স্থায়ী অবস্থান সৃষ্টি করে নেয়।
যদিও বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতায় পালকি প্রায় বিলুপ্তির পথে; কিন্তু গ্রামবাংলার প্রতিটি বাঙালির অনুসন্ধিৎসু মন এখনো তার অজান্তে খুঁজে বেড়ায় হৃদয়ের মণিকোঠায় যত্ন করে তুলে রাখা পালকিটিকে। রক অ্যান্ড রোল, কান্ট্রি, জাজ ইত্যাদি সংগীতে মজে থাকা প্রজন্ম এখনো মাঝেমধ্যে ইউটিউব কিংবা গুগলে খুঁজে দেখে পালকির গান পাওয়া যায় কি না। কেননা, দিনশেষে প্রতিটি পাখিই ঘরে ফেরে। আর প্রতিটি বাঙালিই ফিরে যায় তার শিকড়ের কাছে, আপন নীড়ে। তেমনই একটি ছোট্ট নীড়ের নাম পালকি, তেমনই একটি শিকড়ের সুর ‘পালকির গান’। তাই তো পালকি এবং পালকির গান এখনো আমাদের হৃদয়মন্দিরে বেঁচে আছে বাঙালির লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হিসেবে।