পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। কারণ, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনটি সংশোধন হলেও এই আইন প্রয়োগের জন্য অপরিহার্য বিধিমালা এখনো তৈরি হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি করার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
অথচ কমিশনের কাছে ভুক্তভোগীদের প্রায় ২২ হাজার বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন পড়ে আছে। কমিশন আবেদন গ্রহণের সময়সীমা তুলে দেওয়ায় আরও আবেদন জমা হচ্ছে বলে কমিশনের সূত্র জানায়।
এই অবস্থায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত শুরু করা যায়, সে জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ বিধিমালার একটি খসড়া তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। তবে সেটি নিয়েও সরকারি পর্যায়ে কোনো তৎপরতা নেই বলে ভূমি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে।
উভয় মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনটি সংশোধনে সময় লেগেছে প্রায় ১৬ বছর। এখন বিধিমালা তৈরি, কমিশনের জনবল নিয়োগ এবং দুটি শাখা কার্যালয় খুলতে কত বছর লাগবে, তা দেখার বিষয়। উল্লেখ্য, ২০০১ সালে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনটির সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে।
ভূমি কমিশনের সূত্র জানায়, প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় তারা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জমা পড়া আবেদনগুলো দ্রুত যাচাই-বাছাই করতে পারছে না। রাঙামাটি ও বান্দরবানে কমিশনের যে দুটি শাখা কার্যালয় করার কথা ছিল, তা-ও এখন পর্যন্ত খোলা না হওয়ায় দূর-দূরান্তের অনেক আবেদনকারী দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
ভূমি কমিশন কবে নাগাদ বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু করতে পারবে, জানতে চাইলে কমিশনের অন্যতম সদস্য ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আসলে বিধিমালা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু করা সম্ভব নয়। গত ২৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কমিশনের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিধিমালা ছাড়া কাজ শুরু করে মাঝপথে আটকে যাওয়ার চেয়ে একটু সময় লাগলেও বিধিমালা তৈরি হওয়ার পরই কাজ শুরু করা ভালো হবে বলে সেখানে সবাই একমত হয়েছেন।
কংজরী চৌধুরী বলেন, বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু করতে বিধিমালা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলেও ভূমি বিরোধের আবেদন গ্রহণ ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান থাকবে। আবেদন করার জন্য আগে যে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। সংক্ষুব্ধ যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় ভূমি কমিশনের কাছে আবেদন করতে পারবেন।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিক সমাজের অনেকে প্রথম আলোকে বলেছেন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় আরও কিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অথচ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয়তা তাঁদের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি। কারণ, তাঁরা আশির দশকে নিজেদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন পর্যন্ত কার্যত শরণার্থীর জীবন যাপন করছেন। তা ছাড়া ভূমি কমিশনের রায় পেলেই যে তাঁরা নিজেদের হারানো জায়গা-জমি ফিরে পাবেন, তারও নিশ্চয়তা নেই। কারণ, কমিশনের রায় বাস্তবায়নের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। মাঠপর্যায়ে কমিশনের রায় কে বাস্তবায়ন করবে, তা স্পষ্ট নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী, ওই অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সরকার ১৯৯৯ সালে প্রথম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করে। ওই কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী কার্যভার গ্রহণের আগেই মারা যান। এরপর ২০০০ সালের ৫ এপ্রিল পুনর্গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আবদুল করিম কার্যভার গ্রহণের কিছুদিন পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করেন। ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর পুনর্গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মাহমুদুর রহমান ২০০৭ সালে মারা যান। তবে তিনি কাজ শুরু করতে পারেননি।
এরপর পুনর্গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী কাজ শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, আইন সংশোধন সরকারের বিষয়। সে জন্য কমিশন অকার্যকর থাকতে পারে না। বিদ্যমান আইন অনুযায়ীই কমিশন কাজ করবে। এরপর তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করেন। তখন প্রায় সাড়ে চার হাজার আবেদন জমা পড়েছিল। কিন্তু আইন সংশোধন না করে বিরোধ নিষ্পত্তি কিংবা ভূমি জরিপের উদ্যোগ তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে ভেস্তে যায়। ২০১২ সালের ১৮ জুলাই ওই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়।
এরপর প্রায় দুই বছর কমিশনের অস্তিত্ব ছিল না। ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হককে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে সরকার কমিশন পুনর্গঠন করে। এই কমিশনের অন্য চার সদস্য হচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট সার্কেল প্রধান বা রাজা (যখন যে এলাকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ চলবে, তখন সেই সার্কেলের প্রধান বা রাজা সদস্য হিসেবে কাজে অংশ নেবেন), চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (যখন যে জেলার বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ চলবে, তখন সেই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সদস্য হিসেবে অংশ নেবেন)।