পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের পরিস্থিতি এখন যেন জিয়া ও এরশাদের আমলে ফিরে গেছে।
আজ বুধবার ‘পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন বনাম পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে কথাগুলো বলেন মেনন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছর পূর্ণ হলো গত সোমবার। এ উপলক্ষে আজ ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে এই সংলাপের আয়োজন করে বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন। এতে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সশস্ত্র লড়াই শুরু হয় পাহাড়ে। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন মেনন। তিনি ১৯৭৯ সালে সাংসদ হন। যখন তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে পাহাড়ে বাঙালি অভিবাসন শুরু হয়।
মেনন জানান, তাঁর সংসদীয় আসনের নদীভাঙা মানুষের তালিকা তৈরি করে তাদের পাহাড়ে পাঠানোর জন্য সরকারি নির্দেশ পেয়েছিলেন। তবে তিনিসহ কিছু সাংসদ তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ওই অভিবাসনপ্রক্রিয়া পরে আরেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের সময় পর্যন্ত চলে। মেনন বলেন, ‘জিয়া ও এরশাদ কেউই পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজেননি।’
১৯৯১ সালে তৎকালীন মন্ত্রী অলি আহমদের নেতৃত্বে পাহাড়ে সশস্ত্র লড়াইরত শান্তিবাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে করা কমিটির সদস্য ছিলেন সাংসদ রাশেদ খান মেনন। তবে তৎকালীন সরকারের সময় সমঝোতা শেষতক হয়নি। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চুক্তি হয়। শেষ হয় দুই দশকের লড়াই। ওই চুক্তিতে ৭২টি ধারা ছিল। কিন্তু ২২ বছরেও এসব ধারার বেশির ভাগ বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ করে আসছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)।
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘এত দিনেও চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ধারা বাস্তবায়ন না হওয়া সত্যি হতাশাজনক। চুক্তি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসম্ভব সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার ঐকান্তিকতা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ মেনে নিতে পারেনি।’ তিনি বলেন, ‘এখন পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গি দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে। এখন যেন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে সবকিছু।’
সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে অদৃশ্য বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এর বাস্তবায়নে অকারণ কালক্ষেপণ দেখে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তিনি বলেন, আজ যারা ক্ষমতায়, তারাই এই চুক্তি করেছিল। তাই এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের নিতে হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, এই চুক্তির একটি পক্ষ রাষ্ট্র। তাই তাদের দায়িত্ব বেশি। চুক্তি বাস্তবায়ন করতে আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে।
অনুষ্ঠানের প্যানেল আলোচক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, ‘১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদনের সময় ভাবিনি ২২ বছর পরও এর বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলতে হবে। ভেবেছিলাম, পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি কমবে। কিন্তু আজও তা কমেনি।’
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য সমস্যা কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা না। এটি রাজনৈতিক সমস্যা। এর বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবেশ নেই।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, চুক্তির পর পাহাড়ি মানুষের মধ্যে আশার আলো জ্বলেছিল। সেই আলো নিভে আসছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এএলআরডির চেয়ারপারসন খুশী কবির, পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার আন্দোলনের নেতা জুয়াম লিয়ান আমলাই প্রমুখ।