ফিরে দেখা ২০২১: পারিবারিক নির্যাতন—১

পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে ১০%, ধর্ষণ উদ্বেগজনক

এ বছর বাল্যবিবাহের খবর প্রকাশিত হয়েছে ২৮৪ জনের। ২০২০ সালে যা ছিল ৮৪টি।

কোভিড মহামারির আঘাত ছিল বছরজুড়ে। তবে দুশ্চিন্তায় ভর করে চলতে থাকা জীবন এ বছর কিছুটা অভ্যস্ত হতে থাকে। সেই হিসাবে গত বছর (২০২০) মহামারিতে ঘরবন্দী সময়কে পারিবারিক নির্যাতনের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী করা হলেও এবার সেই যুক্তি টেকে না। তবে চলতি বছর শেষে তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের চিত্রটা আরও উদ্বেগজনক।

বছরের শেষ প্রান্তে (২২ ডিসেম্বর) ঢাকা থেকে কক্সবাজারে স্বামী, শিশুসন্তানসহ বেড়াতে গিয়ে এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সময়ে বান্দরবানে ছেলেমেয়েকে বেঁধে রেখে প্রবাসীর ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে আলোচনায় আসে বাল্যবিবাহের ঘটনা।

বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র নয়টি পত্রিকায় ছাপা হওয়া খবর ও নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তথ্য সংকলিত করে। সংগঠনের তথ্য অনুসারে, গত বছরের তুলনায় এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর—এই ১১ মাসে পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে ১০ শতাংশ। পারিবারিক নির্যাতনকে ঘিরে হত্যা, আত্মহত্যাসহ মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে ৭ শতাংশ। যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ৪০ জন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুসারে, ঢাকায় গত বছরের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা বেড়েছে ৩ শতাংশের বেশি। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের মামলা ১৩ শতাংশ এবং যৌতুকের কারণে হত্যা মামলা ২০০ শতাংশ বেড়েছে। ধর্ষণের মামলা গত বছরের তুলনায় এই ১১ মাসে ২টি কম। ডিসেম্বর মাসের হিসাব যুক্ত করলে ধর্ষণের মামলাও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

১৩টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় বাল্যবিবাহ বেড়েছে ২৩৮ শতাংশ।

সবচেয়ে বেশি পারিবারিক নির্যাতন

এ বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পরিবাগের দুটি ৯ তলা ভবনের মাঝ থেকে উদ্ধার করা হয় স্কলাসটিকা স্কুলের ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সেলর ইভানা লায়লা চৌধুরীর (৩২) লাশ। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। ইভানার স্বামী আব্দুল্লাহ হাসান মাহমুদ রুম্মানের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে দাম্পত্য অশান্তি ছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

বছর শেষে পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আরও দুটি মৃত্যুর ঘটনা আলোচনায় আসে। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইলমা চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে পরদিন স্বামী ইফতেখার আবেদীন, তাঁর মা ও সৎবাবার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। অভিযোগ করা হয়েছে, বিয়ের পর ইলমা পড়া বন্ধ করতে না চাওয়ায় তাঁকে নির্যাতন করা হতো।

১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে বেসরকারি সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মাহমুদা খানমের মৃত্যুর ঘটনায় স্বামী আনিসুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মাহমুদার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্বামীর লাথির আঘাতে আহত মাহমুদা ছয় দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মহামারিতে পারিবারিক নির্যাতন ও মৃত্যু—দুটোই বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫৫৪ ও ৪৫৭-তে। এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬০৮টি। এর মধ্যে ৪৮৭টি মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা ৩৫৫ এবং আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৩২টি।

ধর্ষণ এ বছরও ছিল উদ্বেগজনক

আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছরও ঘরে-বাইরে, গণপরিবহনে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

১৯ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে যাত্রীবাহী একটি বাসে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে এক গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ওই গৃহবধূ জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করলে পুলিশ তাঁকে উদ্ধারের পর অভিযুক্ত বাসচালক ও দুই সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে।

এ ব্যাপারে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাসমালিকেরা চালক ও সহকারীদের দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে পারেনি বলে তাদের দুঃসাহস আরও বাড়ছে। একজন নারীর ভীতিমুক্ত পরিবেশে গণপরিবহনে চলাচলের অধিকার রয়েছে।

এ বছরের ২১ নভেম্বর হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে বাসের চালকের সহকারী যৌন নিপীড়ন করলে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের কারণে সব বিভাগীয় শহরে শিক্ষার্থীদের জন্য বাসভাড়া অর্ধেক করার সিদ্ধান্ত হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৩ জনকে। এ বছরের ১১ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ১ হাজার ২৪৭, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৪৬ জন। এ ছাড়া গৃহকর্মী নির্যাতন ৪১, যৌন হয়রানি ১৯৬ এবং অ্যাসিড সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২২টি।

বাসমালিকেরা চালক ও সহকারীদের দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে পারেনি বলে তাদের দুঃসাহস আরও বাড়ছে। একজন নারীর ভীতিমুক্ত পরিবেশে গণপরিবহনে চলাচলের অধিকার রয়েছে।
মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী, যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব

২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক নারীকে (৩৭) বিবস্ত্র করে নির্যাতনের আলোচিত ঘটনার রায় হয়েছে এ বছরের ৪ অক্টোবর। নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ দুই আসামি দেলোয়ার হোসেন ও মোহাম্মদ আলী ওরফে আবুল কালামকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। গত বছর দেলোয়ার বাহিনী ওই নারীকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিলে বিষয়টি জানাজানি হয় এবং সারা দেশে ধর্ষণ ও নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ওই বছরের ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করে সরকার।

বছরের শেষ ভাগে আলোচনায় বাল্যবিবাহ

করোনা মহামারির কারণে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। বেসরকারি সংগঠন মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, এ বছর বাল্যবিবাহের খবর প্রকাশিত হয়েছে ২৮৪ জনের। এর মধ্যে ১৮৫ জনের বাল্যবিবাহের খবর প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বরে। ২০২০ সালে বাল্যবিবাহের খবর প্রকাশিত হয়েছে ৮৪টি।

বাল্যবিবাহ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সেপ্টেম্বর মাসে ৯টি জেলার ৭৬টি উপজেলার সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রথম আলো। খুলনা, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বরগুনা ও জামালপুরে ৭ হাজার ৬৭৭টি বাল্যবিবাহের তথ্য পাওয়া যায়।

গত বছর মহামারির সময়ে পারিবারিক সহিংসতা যেভাবে বেড়েছিল, তাতে আশঙ্কা করা যাচ্ছিল, এটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। নারীদের কর্মে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টি পারিবারিক প্রথায় ধাক্কা দিয়েছে।
ফওজিয়া মোসলেম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি

পারিবারিক নির্যাতন বাড়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর মহামারির সময়ে পারিবারিক সহিংসতা যেভাবে বেড়েছিল, তাতে আশঙ্কা করা যাচ্ছিল, এটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। নারীদের কর্মে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টি পারিবারিক প্রথায় ধাক্কা দিয়েছে। ফলে পরিবারে নারীর প্রতি অসহনশীল আচরণ করার প্রবণতা থেকে নির্যাতন বাড়ছে। আইনের বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা না পাওয়ায় ধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতনও বাড়ছে।