রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম কত হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। গত শনিবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যাওয়া সাংবাদিকদের ব্রিফিং করার সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সিরাজুল হক খান বলেন, প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে সাড়ে তিন টাকা।
এর আগে গত ২৫ ডিসেম্বর এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) সইয়ের পর জানানো হয়েছিল যে প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে সাড়ে পাঁচ টাকা। আর দেশের বিশেষজ্ঞ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাবে রূপপুর কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম সাড়ে সাত টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
এ ব্যাপারে সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আগে কে কত বলেছিল তাঁর জানা নেই। তিনি অল্প দিন আগে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে তিনি যে দাম বলেছেন (সাড়ে তিন টাকা), সেটিই সর্বশেষ তথ্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের জানামতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম সাড়ে পাঁচ টাকাই পড়বে। তবে এই প্রকল্পের জন্য রাশিয়া যে পরিমাণ ঋণ দেবে (৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ) সেই পরিমাণ অর্থ বিবেচনায় নিয়ে সে দেশের পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটম একটি হিসাব চূড়ান্ত করেছে। তাতে বলা হয়েছে যে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৩ দশমিক ৩৬ মার্কিন সেন্ট, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন টাকারও কম হয়।
তাঁরা বলেন, কিন্তু বিদ্যুতের দাম হিসাব করার জন্য রাশিয়ার ঋণের পাশাপাশি সরকারের বিনিয়োগ (১০ থেকে ১৫ শতাংশ), পরিচালন ব্যয় প্রভৃতিও যুক্ত করতে হবে। এসব যুক্ত করে প্রতি ইউনিটের দাম সাড়ে পাঁচ টাকা বলা হয়েছে।
প্রকল্প এলাকার ব্রিফিংয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসচিব বলেন, প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ (কার্যালয়, আবাসনসহ কিছু সাধারণ পুরকাজ) প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ শেষ হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির মূল কাজ শুরু হবে ২০১৭ সালে। এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট ২০২২ সালে এবং একই ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৩ সালে চালু হবে। সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট বুঝে নেবে যথাক্রমে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে।
ব্রিফিংকালে সচিব ছাড়াও প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এ সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন, পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান আহমেদ জুলকারনাইন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রকল্প এলাকায় সাংবাদিকদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন তথ্য অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শৌকত আকবর বলেন, রূপপুর কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়ার (ডিকমিশনিং) জন্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলার রাখা হবে। তবে এই অর্থ আসবে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা থেকে।
রূপপুর কেন্দ্র স্থাপনে সরকার ও রাশিয়ার মধ্যে সই হওয়া মূল চুক্তি অনুযায়ী এই প্রকল্পে ব্যয় হবে এক লক্ষ কোটি টাকার কিছু বেশি (১ হাজার ২৬৫ কোটি মার্কিন ডলার)। বাংলাদেশে এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প (পদ্মা সেতুর তুলনায় ব্যয় তিন গুণেরও বেশি)। এই প্রকল্পে রাশিয়ার তৈরি ‘ভিভিইআর-১২০০’ প্রযুক্তির পারমাণবিক রিঅ্যাকটর ব্যবহার করা হবে। এটি ‘থ্রি প্লাস’ জেনারেশনের প্রযুক্তি, বিজ্ঞানি ও বিশেষজ্ঞদের মতে যা এখন পর্যন্ত সর্বাধিক নিরাপদ।
প্রকল্পের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, মূল চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগে আরও চারটি চুক্তি সই করতে হবে। এগুলো হচ্ছে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা; স্পেন্ট ফুয়েল (পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপজ্জনক জ্বালানি বর্জ্য) ফেরত নেওয়া; যেকোনো বিষয়ে চাহিদা অনুযায়ী সার্ভিস নিশ্চিত করা এবং পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়ন। এই চুক্তিগুলোর মধ্যেই স্পেন্ট ফুয়েল ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কারিগরি বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হবে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত অর্থিক বা বাণিজ্যিক বিষয় আরও পরে চূড়ান্ত করা হবে।
রাশিয়া প্রকল্পের জন্য যে ঋণ দেবে, তা ব্যয় হবে ৩ হাজার ৭০০ কিস্তিতে। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ সম্পন্ন হবে ৩ হাজার ৭০০ ধাপে (এপিসোড)। প্রতিটি ধাপ শেষ হওয়ার পর ওই ধাপের অর্থ পরিশোধিত হবে। আর সরকার যে অর্থ জোগান দেবে, তা ব্যয় হবে ৩৪টি ধাপে।
রাশিয়ার দেওয়া ঋণের সুদ ৩ শতাংশের বেশি হবে না। প্রকল্পের সমীক্ষার জন্য যে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ হারে। আর মূল চুক্তিতে সুদ ধরা হয়েছে লাইবরের (লন্ডন আন্তব্যাংক লেনদেনে সুদের হার) সঙ্গে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। লাইবর সাধারণত ১ শতাংশের মধ্যেই থাকে।