পরনে টি-শার্ট ও প্যান্ট। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। ছেলেটা যখন প্রথম আলোর অফিসে ঢুকছিল, বোঝার উপায় ছিল না যে, তার একটা পা নেই। তবে তার হাতের লাঠিটি চকিতে পেছনে নিয়ে গেল আমার ভাবনাকে। দুই বছর আগে হাসপাতালের বিছানায় দেখা সেই লিমন! কাটা পা নিয়ে অসহায় শুয়ে-বসে থাকা। চোখে-মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা।
সেই ১৬ বছরের কিশোর এখন ১৮ বছরের তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আশায় ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম পূরণ করতে হবে, অনলাইনে। কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য সহায়তা চাইলে তাকে কারওয়ান বাজারে চলে আসতে বলি। তাই ঈদুল ফিতরের আগে এক বিকেলে এসে হাজির।
কীভাবে এলে?
—ফার্মগেট থেকে হেঁটে চলে এসেছি। পথ তো আর বেশি না।
উড়ালসেতু পার হলে কীভাবে?
(হাতের লাঠিটি দেখিয়ে) এটা কাজে দিচ্ছে। পথচারীরা হাতে লাঠি দেখলে সতর্ক হয়ে হাঁটে। সরে গিয়ে পথ করে দেয়।
দুই বছর আগে, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ এক বিকেলে ঝালকাঠির সাতুরিয়া গ্রামের নিজ বাড়ির পাশে ছোট্ট এই ছেলেটাকে র্যাব পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছিল। একটা পা হারিয়ে বিনিময়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছিল দুটি মিথ্যা মামলা। প্রথম আলোতে এ খবর প্রকাশের পর মানুষ চিকিৎসার সহায়তায় তার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
মুখে সারাক্ষণ লাজুক হাসির লিমনকে দেখে কে বলবে, কদিন আগে ছেলেটার ওপর এত ধকল গেছে। কাটা পা নিয়ে হাসপাতালে যন্ত্রণাকাতর দিন, মাথার ওপর মামলার খড়্গ, র্যাবের দেওয়া সন্ত্রাসী তকমা, র্যাবের কথিত সোর্স স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হুমকি, দরিদ্র পরিবারটির বাকি সদস্যদের গ্রামছাড়া হওয়া, মাসে মাসে আদালতে মামলার হাজিরা—কত ঝড় যে বয়ে গেছে ১৬ বছরের এই কিশোরের ওপর দিয়ে।
লিমনের ওপর নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ ওঠে নানা মহল থেকে। তার পরও তাকে সন্ত্রাসী প্রমাণের জন্য চলে নানা তৎপরতা। অসহায় এই কিশোরের বিরুদ্ধে নেমে পড়ে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বললেন, লিমন সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। তার শ্রমজীবী বাবাও নাকি সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। তারেক সিদ্দিকের এই বক্তব্যকে ‘সরকারের বক্তব্য’ বলে পরদিন জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের এসব বক্তব্যের পর সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের পক্ষ থেকে কমান্ডার এম সোহায়েল (তৎকালীন পরিচালক, গণমাধ্যম) বললেন, কেবল লিমন ও তার বাবাই নয়, তার মা ও কলেজপড়ুয়া বোনও সন্ত্রাসী।
এত কিছুর পরও দমে যায়নি অজপাড়াগাঁয়ের কিশোর লিমন হোসেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের দেওয়া সব অপবাদ অসত্য প্রমাণ করে ফিরেছে নতুন জীবনে।
চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪ পেয়ে পাস করেছে। ইচ্ছা আইন পড়বে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম জমা দিয়েছে। প্রথম পছন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এর মধ্যেও ঘুরেফিরে লিমনের একটাই জিজ্ঞাসা, যারা তাকে পঙ্গু করে দিল, তাদের কি বিচার হবে না? বলল, ‘আমার খুব ইচ্ছা করে একদিন র্যাবের হেড অফিসে যাই। বলি, স্যার, আমার কী অপরাধ ছিল? কেন আমারে পঙ্গু করে দিলেন?’
জবাব খুঁজে পাই না। বলি, লেখাপড়া করো, ভালো ফল করো, ভালো মানুষ হও, ধরে নাও এটাই তোমার জবাব।
লিমনকে বাকি জীবন কৃত্রিম পায়ে ভর করেই চলতে হবে। তবে তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা তো অকৃত্রিম। মানুষের ভালোবাসায় ভর করে লিমন যাক বহু দূর।
টিপু সুলতান: বিশেষ প্রতিনিধি