পানি শোধনাগার প্রস্তুত, সরবরাহ কীভাবে

প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতার ‘পদ্মা-জশলদিয়া পানি শোধনাগার’ অক্টোবরে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের কথা। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় নির্মিত এই শোধনাগারের অভ্যন্তরীণ সরবরাহ পাইপ লাইন (নেটওয়ার্ক) নির্মাণে ঢাকা ওয়াসা এখন পর্যন্ত কাজই শুরু করেনি। এ কারণে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় তৈরি এ শোধনাগারের পানি নির্ধারিত এলাকার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কবে নাগাদ পাবে, তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

আট মাস আগে শোধনাগারের নির্মাণকাজ শেষ হলেও মূল সংরক্ষণাগারে অনেক ছিদ্রের (লিকেজ) সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, পদ্মা নদীর যে অংশ থেকে পানি নেওয়া হবে, সেখানেও রক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

২০১৪ সালের শুরুতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। গত পাঁচ বছর অভ্যন্তরীণ সঞ্চালন ও সরবরাহ লাইন নির্মাণের কাজ হয়নি। কথা ছিল, ২০১৬ সালের মধ্যে মূল শোধনাগারের কাজ শেষ করা হবে। কিন্তু মাঝপথে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা। এসব এলাকার জন্য মিটফোর্ড থেকে বেড়িবাঁধ ধরে হাজারীবাগ, লালবাগ হয়ে শ্যামলী পর্যন্ত বেড়িবাঁধের পাশে ও ভেতরের অলিগলিতে ৪০ কিলোমিটার সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন করার কথা। একই সঙ্গে গাবতলী ও মিরপুর-১ নম্বর সেকশনেও এর পানি নিয়ে যাওয়ার কথা। এ ছাড়া মিটফোর্ড এলাকা থেকে নর্থ সাউথ রোড পর্যন্তও পানি সরবরাহের কথা। অভিযোগ রয়েছে, শোধনাগার নির্মাণকালে কয়েক বছর সময় পাওয়া গেলেও অভ্যন্তরীণ পাইপ লাইন নির্মাণের উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, আপাতত পুরোনো নেটওয়ার্কেই পানি সরবরাহ করা হবে। এই শোধনাগারের জন্য নতুন সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন না করার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রকল্পটিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন ‘ইমপ্রুভমেন্ট নেটওয়ার্ক’ করা হবে।

অভ্যন্তরীণ পাইপলাইনের জন্য সম্প্রতি ৯২৫ কোটি টাকার আলাদা একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘পদ্মা-জশলদিয়া পানি শোধনাগারের নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্প’। এর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে তা গত সপ্তাহে একনেকে পাঠানো হয়।

>

২০১৪ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়
গত পাঁচ বছরে পানি সরবরাহের জন্য অভ্যন্তরীণ সঞ্চালন ও সরবরাহ লাইন নির্মাণের কথা ভাবা হয়নি

প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, নেটওয়ার্ক প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছরের। অর্থাৎ সরকারি অর্থ পেয়ে এখনই যদি কাজ শুরু করা হয়, তাহলেও ২০২১ সালের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এখন জোড়াতালি দিয়ে পুরোনো নেটওয়ার্কে কিছু পানি সরবরাহের চেষ্টা করা হবে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামসহ মন্ত্রণালয় ও ওয়াসার কর্মকর্তারা গতকাল সোমবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে শোধনাগারটি চালু হবে। তবে এখনই সব পানি সরবরাহ করা যাবে না।

সংরক্ষণাগারে ছিদ্রপথ, বাঁধে ফাটল

২৩ সেপ্টেম্বর মাওয়া চৌরাস্তা থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে জশলদিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, বিশাল এলাকাজুড়ে (৮২ একর) দেয়ালঘেরা এই শোধনাগার। উপস্থিত গ্রামবাসী ও শ্রমিকদের কয়েকজন শ্রমিক জানান, প্রধান শোধনাগারটি নিয়ে প্রায় ছয় মাস ধরে সমস্যা চলছে। সেখানে অনেক ছিদ্রপথ সৃষ্টি হয়েছে। বারবার সারানো হয়, আবার শুরু হয়। সেখানে মেরামতকাজে যুক্ত ছিলেন, এমন একজন শ্রমিক বলেন, একবার শোধনাগারের দেয়ালের আস্তর তুলে তারপর মেরামত করা হয়। তারপরও পুরোপুরি ঠিক করা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প সুষ্ঠুভাবেই চলছে। সেখানে ফাটল বা ছিদ্র নেই। একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, শোধনাগার থেকে ৩০ কিলোমিটার প্রধান পাইপলাইন বসানো হয়েছে কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত। সেই পাইপলাইনের কাজও সুরক্ষিতভাবে করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রায় চার মাস আগে প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি জশলদিয়ায় পাইপ ফেটে যায়। তড়িঘড়ি করে তা মেরামত করা হয়। কুচিয়ামোড়া এলাকায় ধলেশ্বরী নদীপথে নেওয়া পাইপও জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ভেসে ওঠে, পরে তা মেরামত করা হয়।

মধ্য জশলদিয়ায় পদ্মা নদীর যে অংশ থেকে পানি আনা হয়, সেখানেও গিয়ে দেখা গেল অব্যবস্থা। নদী থেকে প্রায় দেড় শ মিটার দূরে মোটরস্টেশন। নদীর তীরে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধের পশ্চিম প্রান্তসীমায় একটি অংশ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া বাঁধের মাঝখানেও ফাটল। দেখে সহজেই বোঝা যায়, যথাযথভাবে সুরক্ষা আস্তর না দিয়ে হেলাফেলায় তৈরি করা হয়েছে। অন্তত পাঁচটি অংশে দেখা যায়, ব্লকের পরিবর্তে বাঁধ দেওয়া হয়েছে ইট দিয়ে, আস্তরও দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে নদীর পানি আছড়ে পড়ছে বাঁধে।

মধ্য জশলদিয়ার বাসিন্দা নূরুদ্দিন (নূরু মাতবর) এলাকার নদীভাঙনের অনেক ঘটনার সাক্ষী। তিনি বলেন, যেটুকু বাঁধ দেওয়া হয়েছে, তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। বাঁধ ভেঙে গেলে মোটরস্টেশনটি তলিয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।