সুনামগঞ্জ শহর থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে পানি নামছে খুবই ধীরে। এখনো শহরের ৯০ ভাগ বাড়িঘরে বন্যার পানি রয়েছে। তাই মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে পারছে না।
তবে পানি কমতে শুরু করায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় কিছু দোকানপাট খুলেছে। মানুষজন বাড়িঘর থেকে বের হয়ে বাজার-সদাই, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনছেন। শহরে বেশির ভাগ রাস্তাঘাট এখনো প্লাবিত। এসব সড়কের কোথাও কোথাও হাঁটু, আবার কোথাও কোমরসমান পানি। মধ্য শহরের কিছু বাড়িঘর থেকে পানি নামলেও অন্যান্য এলাকার বাড়িঘর এখনো প্লাবিত আছে। মানুষজন আছেন চরম দুর্ভোগে। মধ্যশহর ছাড়া অন্যান্য এলাকায় এখনো নৌকা ছাড়া অন্য যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। খাবার পানির সংকট রয়েছে সর্বত্র। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় একইভাবে পানি ও খাদ্যসংকট আছে।
আজ সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। সকালে পৌর শহরের মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বনানীপাড়া, ষোলঘর, কাজীর পয়েন্ট, বিহারীর পয়েন্ট, হাসপাতাল, সড়ক ধরে ময়নার পয়েন্ট, হুসেন বখত চত্বর, মমিনুল মউজদীন সড়ক, ডিএস রোড হয়ে আলফাত স্কয়ারে হেঁটে আসতে এই প্রতিবেদকের প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এসব সড়কের কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমরপানি ছিল। সড়কের দুইপাশে অসংখ্য বাড়িঘর, সরকারি বেসরকারি অফিস, দোকানপাট প্লাবিত হতে দেখা গেছে। শহরের বেশি পানি নতুনপাড়া, হাজীপাড়া, সুলতানপুর, কালীপুর, হাসননগনর, বড়পাড়া, মোহাম্মদপুর, সুলতানপুর, মরাটিলা, তেঘরিয়া এলাকায়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
ষোলঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে অন্তত ৪০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তারা এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাননি বলে জানান। ভবনের নিচতলায় এখনো পানি। একটি কক্ষে পানির ওপর কয়েকটি বেঞ্চ বসিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছেন রিকশাচালক ইয়াকুব আলী (৬০)। বেঞ্চের ওপরই রান্নাবান্না করছিলেন তাঁর স্ত্রী বৃষ্টি বেগম (৪০)। এই দুজন জানালেন, বলাকাপাড়া থেকে গত বৃহস্পতিবার রাতে এসে দেখেন উপরে ঠাঁই নেই। পরে পানির মধ্যেই কোনো রকমে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা জানালেন, গত শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত না খেয়ে ছিলেন। ঘর থেকে যখন বের হন তখন ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত। কোনো কিছুই আনতে পারেননি। দোকানপাটও বন্ধ ছিল। পরে একজন শুক্রবার রাতে কিছু চিড়া দিয়েছিলেন। এখনো কোনো ত্রাণ পাননি বলে জানান তাঁরা। ফাতেমা বেগম নামের (৩৫) এক নারী বলেন, ‘নয়জন মানুষ নিয়া আছি। খানি নাই, পানি নাই, রাইত অইলে অন্ধকার। আমরারে কেউ আইয়া দেখছে না।’
ষোলঘর পয়েন্টে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে একটি দোকানে বাজার-সদাই কিনছিলেন ওই এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম। জানালেন, তিন দিন পর বের হয়েছেন। ঘরে এখনো হাঁটুপানি। এক আত্মীয়ের বাসায় পরিবার নিয়ে আছেন। বললেন, ‘আজ দিনটা একটু ভালো, পানি কমছে। এ জন্য বের হয়েছি। এই কয় দিন তো ঘরবন্দী ছিলাম।’
সামনে কিছুটা এগুনোর পর রামকৃষ্ণ আশ্রম প্রাঙ্গণে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি গাড়ি পানির ওপরে রাখা। সড়কের পাশ্চিম পাশে ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় প্রাঙ্গণে তখনো হাঁটুপানি।
এর থেকে কিছুটা পথ এগুলোই কাজীর পয়েন্ট। চার সড়কের এই মোড়ে তখনো কোমরপানি। এক ব্যবসায়ী জানালেন, বৃহস্পতিবার রাতে দোকান বন্ধ করে বাসায় গিয়েছিলেন। আজ এসে দেখেন ভেতরে জিনিসপত্র সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। শুক্রবার এখানে গলাপানি ছিল বলে জানান তিনি। সুমন পাল নামের ওই ব্যবসায়ী বললেন, ‘ঘর বাঁচাব না দোকান রক্ষা করব। এই নিয়ে দোটানায় ছিলাম। পরে যখন ঘরে পানি ঢুকে তখন অন্যত্র আশ্রয় নিই। এ জন্য আর আসতে পারিনি।’
হাসপাতাল রোড় ধরে যেতে যেতে পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনের বাসভবন, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে হাঁটুসমান পানি দেখা গেল। এই পানি ভেঙে দুজন সহকর্মীকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন সিভিল সার্জন মো. আহম্মদ হোসেন। জানালেন, জেলা সদর, শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলা হাসপাতাল ছাড়া আর সবগুলো হাসাপাতাল প্লাবিত। তবে কোথাও সেবা কার্যত্রম বন্ধ হয়নি। সব হাসপাতালে রোগীর পাশাপাশি বন্যার্তরা আশ্রয় নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন জেলা সদর হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আটতলা ভবনে তিল ধারণের ঠাঁই নাই। রোগী আর বন্যার্ত মানুষে ঠাসা। ছয়তলা পর্যন্ত সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধে টেকা দায়। প্রতিটি তলায় অস্থায়ী দোকান দিয়ে বসেছেন কেউ কেউ। অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। হাসপাতালেও বিদ্যুৎ নেই।
হাসপাতাল থেকে নেমে হাসননগর মোড়ে দেখা হয় সুনামগঞ্জ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মশিউর রহমানের সঙ্গে। জানালেন, তাঁদের আওতায় থাকা সব গ্রাহকই বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে বিদ্যুৎহীন আছেন। মধ্য শহরে কিছু জায়গায় বিকেলে বিদ্যুৎ দেওয়া হতে পারে। হাসাপাতালে কীভাবে বিদ্যুৎ দেওয়া যায়, সেটি দেখতে এসেছেন তাঁরা। পুরো সুনামগঞ্জ কবে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে সেটি এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।
হাসননগর হয়ে হুসেন বখত চত্বরে আসার পথে দেখা হয় জেলার প্রবীণ আইনজীবী ও লেখক হোসেন তওফিক চৌধুরীর (৭৯) সঙ্গে। বললেন, ‘৭৪, ৮৮ ও ২০০৪ সালের বন্যা দেখেছি। এত ব্যাপক বন্যা সুনামগঞ্জে আগে কখনো হয়নি। এটা মহাদুর্যোগ।’ তবে সরকারের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা, ত্রাণ তৎপরতা, বাড়িঘরে আটকেপড়া মানুষদের তাৎক্ষণিক উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। মানুষ প্রয়োজনীয় ত্রাণ পাচ্ছে না। মানুষ খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
হুসেন বখত চত্বরের হাঁটুপানি মাড়িয়ে ডিএস রোড ধরে আসার সময় পৌরভবন চত্বরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চোখ পড়ে। পৌরভবন চত্বরের সামনের সড়ক থেকে পানি নেমেছে। পানি ছিল না আলফাত স্কয়ারেও। আলফাত স্কয়ারে কথা হয় শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা এনাম আহমেদের সঙ্গে। বললেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল৷ সুনামগঞ্জ ছিল বিচ্ছিন্ন। এখন ধীরে হলেও পানি কমছে। বৃষ্টিও কম হচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে। একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। এটাই এখন মানুষের কাছে বড় আশার কথা।