‘১২ বছর বয়সে বিয়া হইছে এই সন্তোষপুর গেরামে। এই মুল্লুক আছিল গহিন গজারি বনজঙ্গল, দিনে দুফুরে আইতেই কইলজা ছ্যাঁত কইরা উঠত। পোলার বাপ এই জঙ্গলে কাড (কাঠ) খড়ি কাটত, মরদ পোলা দেইহাই বাপ–মায় বিয়া দিছে। সকালে জঙ্গলে যাইত আর বিয়ান্না (শেষ বিকেলে) কালে আইত। দুই পোলার জন্মের পর হাফানি অসুখে পড়ল সোয়ামি। জঙ্গলে যাইতে পারল না। শেষে নিজেই কুড়াল হাতে জঙ্গলে ঢুকলাম, লাকড়ি খুঁইটা খুঁইটা জড়া কইরা হের পরে বাজারে বেইচা তার লাইগা অসুদপাতি, ঘরের সদাই কইরা আনতাম। এই কষ্ট কইরা মেয়া বিয়া দিছি, পোলাপানগরে বড় করছি, বউ লইয়া আলাদা বাড়ি কইরা থাহে তারা।’
কষ্টভরে কথাগুলো বললেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা আজিরন বিবি। ঘরে তাঁর অসুস্থ স্বামী মকবুল হোসেনকে নিয়ে চরম দারিদ্র্যে দিন পার করছেন। জীবন বাঁচাতেই রাবারবনে শুকনো পাতা খুঁটতে এসেছেন।
আজিরন বিবি বলেন, ‘আমার ৪ পোলা মাইয়া, কেউ আমগর বুড়াবুড়িরে ভাত দেয় না। ৮০ বছর বয়স আমার, এই বয়সে মাইনষ্যের জমিনে কাম করি, বুড়া হইছি দেইখা আমারে মানুষ কামেও নেয় না। এই রাবারবনে হুকনা (শুকনা) পাতা হুড়ি, পাতা খুঁইটা খুঁইটা গেরস্তরে দেই। হারাদিনে ১২০ টেকা দেয় গেরস্ত। আমি এই বয়সে কাম করতে পারি না বাপ, খুব কষ্ট অয় আমার। তারপরও কাম করমু, কিন্তু কামে কেউ নেয় না আমারে। হুনছি দেশে মরি লাগছে, মানুষ ঘর থেইক্যা বাইরে যায় না, কিন্তু আমরা কাম না করলে কী খামু? খিদায় রাইতে ঘুম আহে না, না খায়া মরলেও তো কেউ আমগরে দেখতে আইব না। আমার ঘরদুয়ার নাই, অহন সারা দিন কামের টেকায় ওষুধ কিনলে চাইল কিনতে পারি না, সরকার কতজন রে কত কিছু দেয়, আমরা খালি পাই না। মেম্বার কয় তুমার বয়স হইছে, তুমি কিসের সাহায্য চাও?’
আজিরন বিবি বলতে থাকেন, ‘কেউ দুই দিন কাম করতে দিলে আরেক দিন কামে নেয় না, কও বাপু কেমন লাগে? হায়রে পোলাপান! এত কষ্ট কইরা মানুষ করলাম তগরে, অহন ফিরাও চাস না। কত সময় মনে লয় বাজার থন বিষ কিনা ঘরে খায়া মইরা যাই। সবারে শান্তি দেই দুনায়া থেইকা...।’
গিলে খাওয়া এক ঢোঁক বিষের মতোই বুকটা ঝলসিয়ে দিয়ে কথাগুলো বলছিলেন আজিরন বিবি।
ফাল্গুনের শুরুতেই ঝরে গেছে রাবারবনের সমস্ত পাতা, আবার ফাগুনেই লেগেছে আগুন প্রকৃতিতে। গাছের শাখায় শাখায় কচি সবুজ পাতায় ভরে গেছে পত্রপল্লবীরা আর সূর্যের তপ্ত রোদ, পাতার সব সবুজ ঝলসে দিয়ে আলোর মেদুর যেন লুটোপুটি খাচ্ছে পড়ে থাকা শুকনো পাতার মর্মর শরীরে। নকশালি খেলায় মেতেছে আলোছায়ারা মাটির বুকজুড়ে। এখন আবার দেশে দেশে মহামারি, প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল, চাপা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ঘরবন্দী শহরের মানুষ। শহর থেকেও ঝাঁকে ঝাঁকে গ্রামে ফিরছে মানুষ। অথচ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের এসবে কিছুই আর এখন আসে যায় না, চোখেমুখে এখন শুধুই তাঁদের অন্ধকার।
সারা দেশের মতো করোনার প্রভাব পড়েছে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলাতেও। এর ফলে চরম অর্থকষ্টে দিন পার করছেন সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। ফুলবাড়িয়া উপজেলার প্রধান শস্য ধান, মৌসুমি সবজি, হলুদ, লালচিনিসহ বিভিন্ন কৃষি আবাদের জন্য এই জনপদের সুনাম রয়েছে। চৈত্র মাসে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের চারাগাছ পরিচর্যা, হলুদ উত্তোলন এবং সবজিখেতে কৃষকের কর্মব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও কৃষক এবং দিনমজুরেরা কাজ করতে পারছেন না।
সবার একই অভিযোগ, এখন কাজের পুরো মৌসুম থাকলেও দেশে করোনাভাইরাসের কারণে কোনো গেরস্ত কাজের জন্য আর শ্রমিক নিচ্ছেন না তাঁদের জমিতে। এমন সময় রাবারবনের ঝরে পড়া শুকনো পাতা খুঁটে জড়ো করে জীবিকা নির্বাহ করে চলছেন সন্তোষপুর গ্রামের আজিরন বিবির মতো কমপক্ষে অর্ধশত নারী শ্রমিক, বয়োবৃদ্ধারা। সারা দিন পাতা খুঁটে ৮০ থেকে ১২০ টাকা মজুরি হওয়ায় এই কাজ নারীরাই বেশি করে থাকেন। চরম মজুরিবৈষম্য শুধু নয়, নারী হিসেবে তাঁর মৌলিক অধিকারটুকু নিয়ে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যায় সন্তোষপুর গ্রামে। এই গ্রামের শ্রমজীবী নারীদের বেশির ভাগই স্বামী পরিত্যক্ত। বিয়ের পর সন্তান ফেলে রেখে স্বামী লাপাত্তা, না হয় অসুস্থ, তা না হয় জঙ্গলে বিষধর সাপের দংশনে মারা গেছেন।
মূলত উপজেলার নাওগাঁও ও রাঙামাটিয়া এই ইউনিয়ন দুটি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এসব এলাকায় সবজির আবাদ বেশি হয়। এসব সবজিখেতে ঢাক (ঢাকনা) হিসেবে ব্যবহারের জন্য চাষিরা শুকনো পাতা ব্যবহার করে থাকেন। তাতে মাটি আরও মাটি উর্বর হয়, তাড়াতাড়ি ফসল গজায়।
জানা গেল, গত দুই দিন উনুন জ্বলছে না ৭০ বছরের বিধবা ফুলবানুর সংসারে। দুনিয়ায় সুখ নামের শব্দটার খোঁজ কোনোকালেই পাননি। এক মেয়ের জন্মের পর মারা যান স্বামী, মেয়ের কথা ভেবে পরে আর বিয়ে করেননি ফুলবানু। অন্যের বাড়িতে, অন্যের জমিতে, এই রাবারবাগানের শুকনো পাতা খুঁটে মেয়েকে বড় করেছেন তিনি। পাতাকুড়ানি ফুলবানু তাঁর সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে মেয়ে পরিবানুকে বিয়ে দিয়েছেন গেরস্তবাড়ি। সেই সুখও ভাগ্যে সইল না পরীবানুর। বিয়ের কিছুদিন পর মেয়ের দেখা দেয় ক্যানসার আর তাই নিজের ঘর বিক্রি করে মেয়ের পেছনে খরচ করে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আজ সর্বস্বান্ত ফুলবানু। ভেবেছিলেন জীবনের শেষ বয়সে এসে বাকি কটা দিন সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে কাটাবেন। কিন্তু অভাবের তাড়নায়, দুমুঠো ভাতের জন্য দিন শেষে
কূলকিনারা পান না ফুলবানু। তাই ৭০ বছর বয়সেও তাঁকে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে হয় তাঁকেই। করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নেমে এসেছে। ঘরে অবশিষ্ট শুকনো মুড়ি যা ছিল, তা খেয়ে পার করলেন দুদিন। পরিবারে মা-মেয়ের খাবার জোগাড় করতে আজ বাধ্য হয়ে কাজে বেরিয়েছেন। অন্য সময়ের তুলনায় অর্ধেক মজুরি ১২০ টাকায় এক গেরস্তের পাতা সুরার (পাতা খুঁটে জড়ো করা) কাজ করছেন ফুলবানু অন্য নারীদের সঙ্গে ।
আজন্মের আক্ষেপ নিয়ে ফুলবানু বলেন, ‘জীবনে এত কষ্ট করছি যে কইয়া শেষ করতে পারব না বাবা। দিনের পর দিন উপাস থাকছি, কারণ কাম নাই। কত দিন যে কাম থেইকা ফেরার সময় গাছে দড়ি জুলাইছি মরার লাইগা, কিন্তু মরতে পারি নাই। মাইয়াডার লাইগা আর পারি নাই। ভালা লাগে না এই জীবন, কেউ কারও খোঁজ নেয় না। ভোটের সময় নেতারা খোঁজ নেয়, পরে আর নেয় না। তাই আইজ পাতা কুড়াইতে আইছি। চাইল নাই ঘরে।’
ফুলবানুর কথা শুনে চোখ মুছছিলেন আরেকজন পাতাকুড়ানি, সন্তোষপুর গ্রামের হাজেরা খাতুন (৩৫), স্বামী জালাল মিয়া, তিন মেয়ে এক ছেলে তাঁর। স্বামী জালাল প্রায় প্রতিদিন পেটান। পিটা থেকে বাঁচতে চলে যান বাপের বাড়ি।
এ জীবন নিয়ে হাজেরা খাতুন নিজেই মুখ খুললেন। ‘বাপ–মায় ভালো পোলা দেইখা বিয়া দিছিল, বিয়ার পর দেহি জামাই পাক্কা জুয়াড়ি। জুয়া খেলে, জুয়ার টাকার লাইগা আমারে মাইরধর করে রোজ, বাপের বাড়ি থেইকা মেলা টেকা আইনা দিছি, অহন আর টেকা দিতে পারি না বইলা সে আরেকটা কাজ (বিয়া) করছে। আমারে বাপের বাড়ি চইলা যাইতে কয়। আমি ৪ পোলা–মাইয়া লইয়্যা স্বামীর লাথি খাইয়া ভিটায় পইড়া থাহি। শেষে আমার নামে মামলা করছে, আমারে জেলে নিছে। আমারে কোনো খরচ দেয় না। আমি কইছিলাম আমার কিছু লাগব না, আমারে শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই দেন। স্বামী আরেকটা বিয়া করছে, তাই আমারে পিটায় রোজ। মারধর করে, তাই ৬ মাস বাপের বাড়ি আর বাকি ৬ মাস মাইর খায়া পইড়া থাহি স্বামির ভিটায়। কেউ কোনো সহযোগিতা করে না। পাতাকুড়ানির কাজ করি, কোনো সময় খেতে–খামারেও কাম করি।’
ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটিয়া, নাওগাঁও, এনায়েতপুর, পুটিজানা, আছিম, রাধাকানাই ইউনিয়নের হাটবাজার এবং এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আতঙ্কে প্রায় জনশূন্য হাটবাজারগুলো। করোনা–সচেতনতায় থানা–পুলিশের টহলের পাশাপাশি গ্রাম চৌকিদারেরা ছোট হাটবাজারগুলোতে মানুষের জটলা না করতে সচেতন করে যাচ্ছেন। মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক, উদ্বেগ আর কোথাও–বা ভাসছে গুজবে। এরই মধ্যে কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে কাজ করছেন ফসল কিংবা সবজিখেতে।
বর্তমানে করোনার প্রভাবে বেকার হয়ে যাওয়া গ্রামের শ্রমজীবী এই সব মানুষকে ত্রাণসহায়তার ব্যাপারে ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশরাফুল ছিদ্দিক বলেন, উপজেলায় যেসব শ্রমজীবী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অচিরেই তাঁদের চিহ্নিত করে স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে।
*লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। Imtiazmyn@gmail