তরুণ প্রজন্ম যাতে বইমুখী বা পাঠাগারমুখী হয়, সে জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে নানামুখী উদ্যোগ জরুরি।
দেশে সরকারি গ্রন্থাগার মাত্র ৭১টি।
নিবন্ধিত বেসরকারি গ্রন্থাগার ৮০০টি।
সরকারের জাতীয় গ্রন্থাগার নীতিতে দেশের প্রতি এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে একটি পাঠাগার স্থাপনের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে এই নীতি শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবতা ভিন্ন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দেশে সরকারি গ্রন্থাগার মাত্র ৭১টি। এর বাইরে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত আরও ৮০০ গ্রন্থাগার সরকারিভাবে নিবন্ধিত। তবে দেশে গ্রন্থাগার বা পাঠাগার কতটি, সে হিসাব সরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ধারণা, সব মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দেশে গ্রন্থাগারের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ হতে পারে। পাঠাগার পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন পাঠাগার স্থাপন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চালু থাকা পাঠাগারগুলো সচল রাখা প্রয়োজন। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো না গেলে পাঠাগারগুলো সক্রিয় রাখা কঠিন হবে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম যাতে বইমুখী বা পাঠাগারমুখী হয়, সে জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে নানামুখী উদ্যোগ জরুরি।
মানুষকে গ্রন্থাগারমুখী করতে জাতীয়ভাবে একটি দিবস পালনের ইতিহাস অবশ্য খুব বেশি দিন আগের নয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি উদ্যাপন শুরু হয়। জনগণকে গ্রন্থাগারমুখী করা, পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি, মননশীল সমাজ গঠনের কেন্দ্রবিন্দু ও জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গ্রন্থাগারের ভূমিকাকে দৃঢ় করাই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের লক্ষ্য। এ বছরের জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, ঘরে ঘরে গ্রন্থাগার’।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ধারণা, সব মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দেশে গ্রন্থাগারের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ হতে পারে। পাঠাগার পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন পাঠাগার স্থাপন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি চালু থাকা পাঠাগারগুলো সচল রাখা প্রয়োজন।
গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেশির ভাগ পাঠাগার বন্ধ হয়ে যায়। ছয় মাস পর গত সেপ্টেম্বর থেকে ধুলো-ময়লা ঝেড়ে বেসরকারি পাঠাগারগুলো আবার খুলতে শুরু করে। তবে এখনো বেশির ভাগ পাঠাগার পুরোদমে চালু হয়নি। আর সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলো খুলেছে গত বুধবার।
খিলগাঁওয়ের শহীদ বাকী স্মৃতি পাঠাগারের সম্পাদক আনিসুল হোসেন তারেক প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের তাৎপর্য প্রকৃত অর্থে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হলে গ্রন্থাগারগুলোর পাশে নিবিড়ভাবে দাঁড়াতে হবে। এর জন্য বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেশি দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
দেশে সরকারি ৭১টি গ্রন্থাগারকে দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। আর ৮০০ বেসরকারি গ্রন্থাগারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। দুটো প্রতিষ্ঠানই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সূত্র জানায়, সারা দেশে অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি পাঠাগারগুলোকে ক, খ, গ—তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে অনুদান দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরে ক শ্রেণির একেকটি পাঠাগার বছরে ৬০ হাজার টাকা, খ শ্রেণির পাঠাগার ৪৯ হাজার টাকা এবং গ শ্রেণির পাঠাগার ৪২ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে। এই অনুদানের অর্ধেক দেওয়া হয় নগদ এবং বাকি অর্ধেক টাকার বই দেওয়া হয়।
করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য এ বছর ৮০০ পাঠাগারকে আমরা এককালীন অনুদান দেব। এরপর থেকে এটা নিয়মিত করার চেষ্টা করছি। আর সরকারি ৭১টি গ্রন্থাগার এ বছর অনলাইনের আওতায় আসবে।কে এম খালিদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালনা পরিষদের সদস্য সেলিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঠাগারের মতো শুভ উদ্যোগগুলোতে অবশ্যই বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ালে এর ফল জাতি পাবে।’
পাঠাগার পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরেই অনুদান বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের বক্তব্য, ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্রন্থাগারিকের বেতনসহ একটি পাঠাগার পরিচালনার ব্যয় ঢাকায় মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। ঢাকার বাইরে জেলা বা উপজেলা সদরে তা ১৫ হাজার টাকার কম নয়। কিন্তু জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা একটি পাঠাগারের দুই মাসের ব্যয়ও হয় না। বেসরকারি পাঠাগারগুলোর উদ্যোক্তারা গ্রন্থাগারিকের বেতনটা সরকারিভাবে দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না।
এসব বিষয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের বেসরকারি পাঠাগারগুলো সক্রিয় রাখার জন্য তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। অনুদান কম হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য এ বছর ৮০০ পাঠাগারকে আমরা এককালীন অনুদান দেব। এরপর থেকে এটা নিয়মিত করার চেষ্টা করছি। আর সরকারি ৭১টি গ্রন্থাগার এ বছর অনলাইনের আওতায় আসবে।’
গ্রন্থকেন্দ্র সূত্র জানায়, চলতি বছরে দেশে ৮০০ বেসরকারি পাঠাগারের জন্য বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ অন্তত চার গুণ বাড়ানোর দাবি পাঠাগার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
পাঠাগারের মতো শুভ উদ্যোগগুলোতে অবশ্যই বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ালে এর ফল জাতি পাবেসেলিনা হোসেন, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ৭০ বছরের পুরোনো পাঠাগার সীমান্ত গ্রন্থাগারের নির্বাহী কমিটির সদস্য মানজার চৌধুরী বলেন, একটি পাঠাগারের অনুদান বছরে অন্তত এক লাখ টাকা হওয়া দরকার। বইয়ের জন্য থাকতে হবে আরও ২৫ হাজার টাকা। পাঠাগারগুলোকেই বই পছন্দ করার সুযোগ দিতে হবে। কারণ, গ্রন্থকেন্দ্র থেকে যে বই দেওয়া হয়, তা সংশ্লিষ্ট পাঠাগারের কাছে আগেই থাকতে পারে।
সম্প্রতি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে ঢাকার ১০টি পাঠাগারকে নিয়ে ‘পড়ি বঙ্গবন্ধুর বই, সোনার মানুষ হই’ শিরোনামে তিন মাসব্যাপী পাঠ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি মিনার মনসুর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাইছি আগামী বছর এই কর্মসূচি বিস্তৃত করতে। বরাদ্দ বাড়ানো গেলেই কেবল তা সম্ভব হবে।’