গায়ে স্কুলড্রেস আর পকেটে পাঁচটি টাকা থাকলেই দুপুরে ডাল–ভাত খাওয়া যায়। শুধু স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরে ভাত খাওয়ার এই ‘প্যাকেজ’ চালু করেছেন রাজশাহীর আড়ানীর একজন হোটেল ব্যবসায়ী। চার বছর ধরে তিনি পাঁচ টাকায় শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার খাওয়াচ্ছেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি নিয়মিত এলাকার ভিক্ষুকদের সুবিধার জন্য ‘কয়েন’ নিয়ে টাকার নোট দেন।
এই হোটেল ব্যবসায়ীর নাম বিপ্লব সরকার (৩৫)। বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পূর্বপাড়া মহল্লায়। আড়ানী বাজারের তালতলায় বড়াল নদের ধারে বিপ্লব সরকারের হোটেল। নাম ‘অন্নপূর্ণা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। আড়ানী মনোমোহিনী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই হোটেলে পাঁচ টাকায় দুপুরের খাবার সেরে নেয়।
বিপ্লব সরকারের বাবা শ্যামল সরকারই মূলত এই হোটেলের মালিক। তাঁর বাবা বিকেলে বসেন। এর আগ পর্যন্ত বিপ্লব সরকারকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিপ্লবের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্রামের অধিকাংশ বাচ্চাই বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসে না। অনেকের বেশি টাকা দিয়ে হোটেলে দুপুরের খাবার কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্যও নেই। তারা স্কুলে এসে টিফিনের সময় আশপাশের দোকান থেকে মুখরোচক কিছু একটা কিনে খায়। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অথচ দুপুরে এক প্লেট ভাত খেতে পারলে তাদের শরীরটা ভালো থাকে। এই চিন্তা থেকেই বাবার অগোচরে পাঁচ বছর আগেই তিনি এই প্যাকেজ চালু করেন। তখন থেকেই বাচ্চারা খেতে আসতে শুরু করে। তবে তাঁর বাবা দুই বছর পর বিষয়টি জানতে পারেন। তবে তিনি এতে বাধা দেননি।
বিপ্লব সরকারের হোটেলে পাঁচ টাকায় খেতে হলে তার কথা শিক্ষার্থীদের মানতে হয়। তিনি বাচ্চাদের কয়েকটি শর্তে খেতে দেন। তার প্যাকেজ খেতে হলে অবশ্যই স্কুলড্রেস পরে আসতে হয়। আর খাওয়ার আগে বা পরে বাইরের দোকানে অন্য কোনো মুখরোচক খাবার খাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, তিনি দেখেছেন বেশির ভাগ বাচ্চা এক প্লেটের বেশি ভাত খেতে পারে না। তিনি ভাতের সঙ্গে সবজি আর ডাল দিয়ে একটি প্যাকেজ তৈরি করেছেন। খাওয়ার সময় তিনি খেয়াল করেন, কোনো বাচ্চা যেন সবজি নষ্ট না করে। শরীরের জন্য সবজির বড় প্রয়োজন। তিনি তাদের সবজি খেতে বাধ্য করেন। টমেটোর মৌসুমে টমেটোর সালাদ খেতে বাধ্য করেন। এই প্যাকেজ তিনি পাঁচ টাকায় দেন। তবে পাশাপাশি খেতে বসে কোনো বাচ্চা যদি বেশি টাকা দিয়ে মুরগির মাংস খেতে চায়, তাহলে তিনি পাশের বাচ্চাটাকেও ছোট এক টুকরা মুরগির মাংস ও একটু ঝোল দেন, যাতে তার মন খারাপ না হয়।
বিপ্লব সরকার বলেন, তিনি মনের আনন্দে এটা করছেন। সেবার মানসিকতা থেকে করছেন। কারণ, তাঁর এসএসসি পরীক্ষাটা দেওয়া হয়নি। বাবা তাঁকে ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার জন্য ভারতে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানে গিয়েও পড়াশোনা করেননি। লেখাপড়া না করে কী ভুল করেছেন, এখন তিনি বুঝতে পারেন। এ জন্য যে বাচ্চারা লেখাপড়া শিখছে, তারা যেন শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে, তার জন্য তিনি তাঁর সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারছেন, সহযোগিতা করছেন।
শুধু তা–ই নয়, বিপ্লব সরকারের ভেতরে দেশপ্রেমের বিষয়টি অন্যভাবে দেখা যায়। তিনি তাঁর হোটেলঘরটাকে পতাকার রঙে রাঙিয়েছেন। অর্ধেক লাল, অর্ধেক সবুজ। আরেকটা কাজ করেন তিনি। যে জন্য দিন শেষে সব ভিক্ষুক তাঁর হোটেলে ভিড় করেন। সারা দিনে ভিক্ষা করে এলাকার ভিক্ষুকেরা যা পান, তার প্রায় শতভাগই ‘কয়েন’। শুধু কয়েন দিয়ে কোনো দোকান থেকেই তাঁরা সব জিনিস কিনতে পারেন না। তাঁদের সহায় হচ্ছেন বিপ্লব সরকার। তিনি তাঁদের কয়েনের বদলে টাকার নোট দিয়ে দেন। বিপ্লব বলেন, সারা দিনে তিনি তাঁর খদ্দেরকে ইচ্ছে করেই একটি–দুটি করে দিয়ে সব কয়েন শেষ করে দেন। এটা করতে তাঁর ভালো লাগে।