আরশ মিয়া বছরে পাঁচ থেকে ছয়টি গরু পালন করতেন। গত বছরও পাঁচটি গরু ছিল তাঁর। এবার মাত্র দুটি গরু পালন করছেন। বাকিগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন। লাভ কমেছে। চুরি হয়ে যায়। এসব ঝামেলা পোহাতে চান না। তাই গরু পালন ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন তিনি।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের ক্ষুদ্র খামারি আরশ মিয়া বলেন, ‘মাঠে ঘাস নাই। অথচ গরু খায় বেশি। খড়ের দাম বাড়ছে। বাড়ছে গরু চুরি। এখন আবার নতুন রোগ আইছে। বিক্রি কইরা লাভ খুঁইজা পাওয়া যায় না। এসব কারণে গরু না বাড়াইয়া কমাইয়া ফেলছি।’
আরশ মিয়ার মতো অনেক ক্ষুদ্র খামারি নানান ঝামেলার কারণে খামারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। গরুসহ অন্য গবাদিপশু পালন কমে যাচ্ছে উপজেলায়। এতে ধস নামার শঙ্কা দেখা দিয়েছে পোলট্রি শিল্প ও গরু পালনে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, গত বছরের তুলনায় ভৈরবে গরু পালনের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। একইভাবে কমেছে ছাগল, মহিষ, ভেড়া, কবুতর পালনও। তবে স্থিতিশীল রয়েছে হাঁসের সংখ্যা।
সূত্রটি জানায়, গত বছরের জুলাই মাসের হিসাবে, উপজেলায় গরুর সংখ্যা ছিল ৭৯ হাজার ৫৪৬টি। এর মধ্যে সংকর প্রজাতির ৫২ হাজার ৪৫০টি, আর দেশি গরু ২৭ হাজার ৯৬টি। ব্যক্তি পর্যায় ছাড়াও ৬৩টি খামারে এসব গরু পালন হয়। তবে গত এক মাসে মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গরুর সংখ্যা অনেক কমেছে। ক্ষুদ্র খামারিরা তাঁদের প্রায় অর্ধেক গরুই বিক্রি করে দিয়েছেন।
গত জুলাইয়ের হিসাবে, উপজেলায় মহিষ ৫৬০টি, ছাগল ১৩ হাজার ২৬০, ভেড়া ১ হাজার ৩৫০, ব্রয়লার মুরগি ১ লাখ ১৬ হাজার, লেয়ার ২ লাখ ১০ হাজার, সোনালি ৩ লাখ, দেশি ১ লাখ ২০ হাজার, টার্কি মুরগি ৩৬২ ও কবুতর ছিল ৬ হাজার ৪০০টি।
সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মরত ব্যক্তিরা মাঠ পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, ভৈরবে আশঙ্কাজনক হারে দিন দিন প্রাণিসম্পদ কমে আসছে। সম্প্রতি ধস নেমেছে পোলট্রি শিল্পে। খামারে নতুন নতুন রোগের সংক্রমণ, মুরগি ও ডিমের দাম কমে যাওয়া, বিপরীতে মুরগির খাবারের মূল্য না কমায় পোলট্রি শিল্পের দুরবস্থা।
পৌর শহরের চণ্ডীবের এলাকার মুরগির পাইকারি ব্যবসায়ী মাসুদ মোল্লা বলেন, খামারে অসুস্থ মুরগির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সবাই বিক্রি করে খামার খালি করার চিন্তায় আছেন। দাম পড়ে গেছে। ভৈরবে মুরগি খুচরা মূল্য কেজিপ্রতি ১১০-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক গরুর খামার বন্ধ হয়ে গেছে। খামারিরা গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। ৬৩টি খামারের মধ্যে বর্তমানে ২৫টি খামারে গরু রয়েছে। তা–ও আবার গরুর সংখ্যা কম। শিবপুর ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামের খামারি আবদুল লতিফ বলেন, একটি গরু দিনে কম করে হলেও ১০ কেজি ঘাস খায়। খড় ও ভুসির খরচ তো আছেই। বিপরীতে দুধের দাম কমে গেছে। বর্তমানে দুধের বাজার লিটারপ্রতি ৪০ টাকায় আটকে আছে। অথচ কয়েক মাস আগেও দাম ছিল ৮০ টাকা লিটার। এ অবস্থায় খামার শূন্য করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
গরুর পাশাপাশি ছাগল পালনের চিত্রও একই। সাত মাস আগেও শিবপুর ইউনিয়নের ফাঁড়ি রঘুনাথপুর গ্রামের আক্তার মিয়ার খামারে ছাগল ছিল ৯০টি। এখন কমে হয়েছে মাত্র ৫টি। খাবার না থাকায় এবং নানান রোগের সংক্রমণের কারণে তিনি ছাগল বিক্রি করে দিয়েছেন। ছাগল পালনে আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে আক্তার বলেন, ‘অনেক সমস্যা। অন্যের জমিতে মুখ দেয়। আবার বিক্রিমূল্য আর পালনখরচ সমান সমান হয়ে যায়। এসব কারণে ছাগল কমিয়ে দিয়েছি।’
একই গ্রামের মোক্তার হোসেন কবুতর পালন করেন। এক বছর আগে তাঁর কবুতরের সংখ্যা ছিল ২০ জোড়া। এখন এসে ঠেকেছে ৫ জোড়ায়। কমিয়ে ফেলার কারণ সম্পর্কে মোক্তার হোসেনের ভাষ্য, ‘দাম খারাপ নয়। সমস্যা হলো রোগে ধরে। তখন বাঁচিয়ে রাখা যায় না। এ কারণে ধীরে ধীরে কমিয়ে এনেছি।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খান বলেন, প্রাণিসম্পদ টিকিয়ে রাখার বিষয়ে ভৈরবে দক্ষ ও মনোযোগী খামারির সংখ্যা কম। তাঁদের ভাবনা মৌসুমকেন্দ্রিক। অর্থাৎ ঈদের আগে খামারে গরু উঠিয়ে বিক্রি করে খালি করা। অন্য প্রাণীর বেলায়ও খামারিদের কাছে মৌসুমটা বেশি গুরুত্ব পায়। তিনি বলেন, ‘এ কারণে এই খাতে না এগিয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিছু মানুষকে প্রাণিসম্পদ বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হবে। বছরব্যাপী কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করবে, এমন মানসিকতা সৃষ্টিতে কাজ করা গেলে পরিস্থিতি পাল্টাবে।’