সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি

পর্যাপ্ত ত্রাণ এখনো পৌঁছায়নি

ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ত্রাণ পাচ্ছেন না অনেকে। জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বন্যার্তদের বিপরীতে বরাদ্দ করা ত্রাণ নিতান্তই অপ্রতুল।

ত্রাণের অপেক্ষায় বানভাসি মানুষ। গতকাল সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সামনে
ছবি প্রথম আলো

কয়েক শ বানভাসি মানুষ জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে। তারা যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও ত্রাণপ্রত্যাশী বন্যার্ত মানুষ সরেনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুউচ্চ লোহার ফটকের সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। ত্রাণ পেতে কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণেরও চেষ্টা করেন।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের সামনে এমন দৃশ্য দেখা যায়। তখন সেখানে অপেক্ষা করছিলেন সত্তরোর্ধ্ব ফুলেলুর বেগম। তাঁর বাড়ি মীরেরগাঁও গ্রামে। স্বামীহারা ফুলেলুর মেয়ের বাড়িতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘চউখে দেখি না, কানেও শুনি না। আমি অভাবী মানুষ। খাওন নাই ঘরে। চেয়ারম্যানের কাছে আইছি। এক প্যাকেট কুনোতা পাইলেই খুশি হইলাম নে।’

তবে শেষ পর্যন্ত ফুলেলুরের হাতে ত্রাণ ওঠেনি। দীর্ঘক্ষণ ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা বানভাসি মানুষ শূন্য হাতে, হতাশমনে বাড়ি ফিরে গেছে। কান্দিগাঁও ইউনিয়নের ৪১টি গ্রামে ৭০ হাজার মানুষের বাস। বন্যার পানিতে তলিয়েছে সব কটি গ্রাম। এর বিপরীতে উপজেলা প্রশাসন এ ইউপিতে ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ দিয়েছে ৪ মেট্রিক টন চাল।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ২৫০টি ত্রাণের বড়সড় প্যাকেট এবং আরও ২৫০টি শুকনা খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ জন ৫ কেজি করে চাল পেয়েছেন। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে ওই ইউপি কার্যালয় থেকে ৩১২ জন বন্যার্তকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন জনপ্রতিনিধিরা।

‘আস্তে আস্তে যোগাযোগ বিড়ম্বনা ঘুচছে, নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে। এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, খাবার পৌঁছানো এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ।’
মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার

কান্দিগাঁও ইউপির চেয়ারম্যান মো. আবদুল মনাফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিয়নটিতে প্লাবিত হওয়া গ্রাম আর দরিদ্র মানুষের বিবেচনায় সরকারিভাবে যে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এর পরিমাণ খুবই কম। বরাদ্দ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। ত্রাণ এতই কম যে কাকে রেখে কাকে দেব—সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে ত্রাণ না পেয়ে স্বাভাবিক কারণেই ক্ষোভ দেখাচ্ছেন। আমরাও এ নিয়ে বিব্রত ও অসহায়।’

শুধু কান্দিগাঁওতেই নয়, সিলেটের অনেক জায়গায় বন্যার্তদের কাছে ত্রাণ তেমন একটা পৌঁছায়নি। যাওবা এসেছে, তা খুবই অপ্রতুল। গতকাল বেশ কিছু এলাকায় বন্যার্ত ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

ত্রাণের আশায় কান্দিগাঁও ইউপি কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষারত ২১ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, বন্যার পানিতে বন্দী হয়ে তীব্র খাদ্যসংকটে পড়েছেন তাঁরা। অনেকে আধা পেট খেয়ে কিংবা চিড়া-মুড়ি খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁরা খুব বিপদে আছেন। এ অবস্থায় ইউপি কার্যালয়ে এসেও সমাধান মিলছে না।

মুঠোফোনে কথা হয় সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত আজমেরী হকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আমরা ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছি। প্রথম দিকে আশ্রয়কেন্দ্রেই মানুষ বেশি ছিল। ইদানীং পানি যেহেতু একটু কমছে, মানুষও ঘরে ফিরছে। আশা করছি, আমরা প্রতিটি ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পারব।’

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, জেলায় ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে চালু হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন ১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬ জন। এখানে গবাদিপশু ঠাঁই পেয়েছে ২৬ হাজার ৩২৫টি। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৬৪২ মেট্রিক টন চাল, ৮ হাজার ২১৮ ব্যাগ শুকনা খাবার এবং ১ কোটি ৪২ লাখ নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

এই আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারিভাবে কোনো ত্রাণ দেওয়া হয়নি।
সিরাজুল ইসলাম (৭৫), সিরাজুল হক সিরাই (৫৬), রেহা বেগম (২৩), আক্তার হোসেনসহ (৩৯) ১২ জন, আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া জাঙ্গাইল গ্রামের

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি

বৃষ্টি না হওয়ায় ষষ্ঠ দিনে এসে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। অনেক বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট থেকে পানি নেমেছে। খুলতে শুরু করেছে দোকানপাটও। তবে জেলার বিভিন্ন জায়গায় এখনো বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। এ ছাড়া আগের দিনের মতো গতকালও অনেক বানভাসি মানুষ অভিযোগ করেছে, তাঁদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না।

এদিকে বন্যার পানির স্রোতে তলিয়ে মারা যাওয়া তিনজনের লাশ গতকাল পুলিশ উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে জৈন্তাপুর উপজেলায় এক মা ও তাঁর ছেলে রয়েছেন। এ নিয়ে সিলেট বিভাগের চার জেলায় বন্যার কারণে ২৩ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের পরিচালক হিমাংশু লাল রায় প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।

অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ৬টি পয়েন্টের মধ্যে ৫টি পয়েন্টেই গতকাল পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে এখন পানি কমতে শুরু করেছে।

গতকাল দেখা গেছে, কিছু কিছু অংশে পানি থাকলেও সিলেটের সব কটি উপজেলার সঙ্গে পুনরায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। তবে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, সিলেট সদর উপজেলার অনেক বাড়িঘর থেকে এখনো পানি নামেনি। সিলেট নগরের অন্তত ২০টি এলাকার বাসাবাড়ি থেকেও পানি সরেনি।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আস্তে আস্তে যোগাযোগ বিড়ম্বনা ঘুচছে, নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে। এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, খাবার পৌঁছানো এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ।’

বৃষ্টি না হওয়ায় ষষ্ঠ দিনে এসে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। অনেক বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট থেকে পানি নেমেছে। খুলতে শুরু করেছে দোকানপাটও। তবে জেলার বিভিন্ন জায়গায় এখনো বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। এ ছাড়া আগের দিনের মতো গতকালও অনেক বানভাসি মানুষ অভিযোগ করেছে, তাঁদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না।

আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি ত্রাণ

গতকাল বিকেলে সিলেট সদর উপজেলার সফির উদ্দিন হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, দুটি চারতলা এবং একটি করে তিনতলা ও দোতলা ভবনের নিচতলা বাদে প্রতিটি তলায় অসংখ্য মানুষ গাদাগাদি করে আছে। প্রতিটি কক্ষই স্যাঁতসেঁতে ও ভেজা। বিভিন্ন কক্ষে তেলাপোকা ও ইঁদুর ছোটাছুটি করছে। অনেক স্থানে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ভবনগুলোর সামনের মাঠ ও আশপাশের এলাকায় এখনো হাঁটুপানি।

আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকজন জানান, গত শুক্রবার থেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষজন ঠাঁই নিতে থাকে। শুরুতে ১৫৫টি পরিবার আশ্রয় নেয়। এসব পরিবারের মোট সদস্যসংখ্যা সব মিলিয়ে অন্তত ১ হাজার ১০০ হবে।

পানি কমতে থাকায় গতকাল থেকে মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে শুরু করেছে। তবে এখনো ১২০ থেকে ১৩০টি পরিবার আছে। তবে এ আশ্রয়কেন্দ্রে বেসরকারিভাবে অনেকে সহযোগিতা করলেও সরকারিভাবে কোনো ত্রাণ দেওয়া হয়নি বলে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন।

আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া জাঙ্গাইল গ্রামের সিরাজুল ইসলাম (৭৫), সিরাজুল হক সিরাই (৫৬), রেহা বেগম (২৩), আক্তার হোসেনসহ (৩৯) ১২ জন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এই আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারিভাবে কোনো ত্রাণ দেওয়া হয়নি। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন এবং ব্যক্তি উদ্যোগে এখানে চিড়া, মুড়ি, গুড়সহ বিভিন্ন শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কিছু ব্যক্তি রান্না করা খাবারও দিয়েছেন।