একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের সংখ্যা আরও কমে গেল। এবারের নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২৫ হাজারের বেশি পর্যবেক্ষক অনুমোদন করলেও এনজিও ব্যুরোর অনাপত্তিপত্র না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৭ হাজার পর্যবেক্ষক পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাবেন।
পর্যবেক্ষকের এই সংখ্যা ২০০১ সালের নির্বাচনের তুলনায় ১২ ভাগের এক ভাগ এবং ২০০৮ সালের তুলনায় ৯ ভাগের এক ভাগ কম। তবে আমেরিকার ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রতিষ্ঠান এনডিআইয়ের পক্ষে কাজ করা অ্যানফ্রেল এবং ইইউ পর্যবেক্ষণ না করলেও শেষ পর্যন্ত বিদেশি পর্যবেক্ষকের সংখ্যা দু শ ছাড়াতে পারে।
ইসি সচিবালয় থেকে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে ৮১টি প্রতিষ্ঠান ৩৪ হাজার ৬৭১ জন পর্যবেক্ষকের জন্য ইসিতে আবেদন করে। সেখান থেকে ইসি বাছাই করে ২৫ হাজার ৯২০ জন দেশি পর্যবেক্ষকদের তালিকা অনুমোদন করে। এদের মধ্যে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) ২২টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৫ হাজার পর্যবেক্ষক রয়েছে। বাকি ৫৯টি প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষকের সংখ্যা ১০ হাজার ৯২০ জন।
ইডব্লিউজি সূত্র জানায়, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশি অনুদান পেয়ে থাকে, তাদের টাকা ছাড়ের জন্য এনজিও ব্যুরো থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। একই সঙ্গে এনজিও ব্যুরোর অনাপত্তিপত্রের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করতে হয়। ইডব্লিউজির প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা পেয়ে থাকে এশিয়া ফাউন্ডেশন, ইউকেএইড ও ইউএসএইড থেকে। যে কারণে এসব প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেক্ষণের টাকা ছাড় করাতে হলে এনজিও ব্যুরো ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়।
ইডব্লিউজি সূত্র জানায়, গতকাল মঙ্গলবার এনজিও ব্যুরো ইডব্লিউজির সাতটি প্রতিষ্ঠানকে অনাপত্তিপত্র দিয়েছে। এগুলো হলো—জানিপপ, সলিডারিটি, উত্তরণ, এসিডি, আইইডি, জিইউকে ও বাঁচতে শেখা। বাকি ১৫টি প্রতিষ্ঠান এখনো অনাপত্তিপত্র পায়নি। আর শেষ মুহূর্তে অনাপত্তিপত্র পেলেও তাদের পক্ষে পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। কারণ পর্যবেক্ষণে অংশ নেওয়ার জন্য পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। আর প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো সময় এখন আর তাদের হাতে নেই। নির্বাচনের বাকি আর তিন দিন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইডব্লিউজির চেয়ারপারসন আবদুল আউয়াল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, এখন অনাপত্তিপত্র বা টাকা ছাড় পেলেও পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় নেই। যে কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়।
আবদুল আউয়াল জানান, এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন না পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নিজস্ব কিছু তহবিল এবং প্রশিক্ষিত কিছু জনবল আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা স্বল্প পরিসরে কিছু এলাকায় পর্যবেক্ষণ চালাবেন। তবে সেই সংখ্যা কোনোভাবেই এক হাজারের বেশি হবে না।
ইসি সচিবালয়ের নথি থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের নির্বাচনে ২ লাখ ১৮ হাজার দেশি এবং ২২৫ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশি পর্যবেক্ষক ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ১১৩ জন এবং বিদেশি ৫৯৩ জন। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে দেশি পর্যবেক্ষক ছিলেন ৮ হাজার ৮৭৪ জন। বিদেশিদের মধ্যে ছিলেন ফেমবোসার চারজন।
এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ, লাইট হাউস, খান ফাউন্ডেশন ও ডেমোক্রেসি ওয়াচের বিষয়ে এবং বিএনপি জানিপপকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি না দেওয়ার আবেদন করেছে।
তবে ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেছেন, আপত্তি জানানো হলেও এই সংস্থাগুলো ইসিতে নিবন্ধিত। আইনগতভাবে নিবন্ধন বাতিল করা জটিল প্রক্রিয়া। যেহেতু তারা ইসিতে নিবন্ধিত, তাই তাদের পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত রাখা যাবে না। তবে একটু জেনে-শুনে-বুঝে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে।
কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ইসি উদার হলেও এনজিও ব্যুরো বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদার আচরণ করেনি। এ অবস্থার মধ্যই আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কোচেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম আরও সাতটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে দাবি করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—জাগরনী চক্র ফাউন্ডেশন, নবলোক, কোস্ট ট্রাস্ট, শরিয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি ও নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এনআরডিএস)।
এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আবদুল আউয়াল বলেন, অভিযোগটি আমাদের জন্য বিব্রতকর এবং আপত্তিকর। কারণ এই তালিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বিদেশি পর্যবেক্ষক
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকের সংখ্যা ছিল সাকল্য চারজন। বুধবার ইসি সচিবালয় থেকে যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে ১৮টি সংগঠন বা রাষ্ট্রের ১৭৬ পর্যবেক্ষকের এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ফ্রান্স দূতাবাসের ৪, জাপানের ৯, স্পেনের ১, ডেনমার্কের ৩, নরওয়ের ২, সুইজারল্যান্ডের ৬, ইউএস দূতাবাসের ৬৫, জার্মানির ৮, নেদারল্যান্ডসের ৪, কানাডার ৭, ব্রিটেনের ১৮, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ২৪, ডিকেআই-নেপালের ৩, ইইউ-এর ২, আইআরআইয়ের ৪, এশিয়া ফাউন্ডেশনের ৭ ও সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ৯ জন।
ইসি সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব এস এম আসাদুজ্জামান জানান, ভোটের আগ পর্যন্ত বিদেশি পর্যবেক্ষকের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, যথাসময়ে ছাড়পত্র ও ভিসা না দেওয়ায় তাদের সংগঠনগুলো এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে না। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় তাদের ব্যাংককভিত্তিক আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা দ্য এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (অ্যানফ্রেল) নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটনভিত্তিক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) মাধ্যমে অ্যানফ্রেলকে অর্থায়ন করে থাকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগে জানিয়েছে, এবারের নির্বাচন তারা পর্যবেক্ষণ করবে না।