যেকোনো প্রকল্প শুরু করতে গেলে প্রথমে একটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয়। বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যকরণীয়। মহেশখালীতে ২৬টি বড় প্রকল্প হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ (ইসিআর) অনুযায়ী এগুলোর ২২টি লাল অর্থাৎ মারাত্মক পরিবেশদূষণকারী প্রকল্প। বাকি চারটি কমলা অর্থাৎ মাঝারি মাত্রায় দূষণের শ্রেণিভুক্ত।
প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগেরই পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা (ইএসআইএ) দরকার। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন কর্মপরিকল্পনাও (আরএপি) জরুরি।
মহেশখালীতে যেহেতু একসঙ্গে অনেক প্রকল্প হচ্ছে, ওই পুরো এলাকার জন্য একটি সামগ্রিক সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। একটি প্রকল্প আরেকটিকে প্রভাবিত করছে কি না, সেটা দেখতে হবে। বিষয়টা অনেকটা আমাদের শরীরের মতো। কারও কিডনির সমস্যা হলে সেটার ওষুধ লাগবে। কিন্তু সেই ওষুধ আবার যকৃতের জন্য কোনো সমস্যা করবে কি না, চিকিৎসককে কিন্তু তা-ও ভেবে দেখতে হবে। এ জন্য ভালো চিকিৎসকেরা চিকিৎসাপত্র দেওয়ার আগে রোগীর স্বাস্থ্যের সামগ্রিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করান। তারপর সব দিক বিবেচনা করে তাঁরা নির্দিষ্ট রোগের ওষুধ দেন।
আবার সব প্রকল্পের সম্মিলিত প্রভাবে ক্ষতির ঝুঁকি খতিয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া প্রকল্পকেন্দ্রিক ইআইএগুলো যথাযথ হয়েছে বা হচ্ছে কি না, তার নজরদারি চাই। পরিবেশের ক্ষতি কমানো এবং বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য করা সুপারিশগুলো মানা হচ্ছে কি না, তা-ও দেখতে হবে।
তবে পরিবেশগত প্রভাবের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়ও ভাবতে হবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কিন্তু এক স্থানে একই সঙ্গে অনেক শিল্পকারখানা আর বড় প্রকল্প হয়। এর কিছু সুবিধার দিক আছে।
মহেশখালীতে সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। দ্বীপের কাছেই সমুদ্রের গভীরতা আছে। এতে করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পকারখানাগুলোর ভারী যন্ত্রপাতি আর কাঁচামাল আনতে সুবিধা হবে। এই সুবিধা দেশের অন্য জায়গায় পাওয়া কঠিন। অন্যদিকে দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদাও মেটাতে হবে। তাই পরিবেশ ও প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটা ভারসাম্য আনা প্রয়োজন।
সার্বিকভাবে শিল্পাঞ্চলের জন্য কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়। যেমন ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প যখন সাভারে নেওয়া হলো, সেখানে একটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র (ইটিপি) স্থাপন করা হলো। ওই যন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে নানা অভিযোগ আছে, কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কথা হচ্ছে, মহেশখালীসহ যেকোনো বড় শিল্পাঞ্চলে প্রতিটি শিল্পকারখানার জন্য আলাদা ইটিপির পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় ইটিপি থাকতে হবে।
অন্যদিকে মহেশখালী–মাতারবাড়ীতে বিনিয়োগের একটি ভূরাজনৈতিক দিক আছে। সেখানে মূলত জাপানের নেতৃত্বে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে। আবার ওই এলাকায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো গড়ে উঠেছে। আরাকানকে একটি আলাদা রাষ্ট্র করার কথা উঠছে। একসঙ্গে এতগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই ভূরাজনীতিকে মাথায় রাখতে হবে। দেখতে হবে, কোন উৎস থেকে কী ধরনের শর্তে বিনিয়োগ আসছে। ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিশোধের সক্ষমতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
প্রশ্ন আরও আছে। এসব উন্নয়নের সুবিধাভোগী হবে মূলত শহরের মানুষ। কিন্তু মহেশখালীর মানুষ কতটুকু সুবিধা পাবে? উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ কি দ্বীপবাসী পাবেন? যাঁদের জমিতে শিল্পকারখানা হবে, যাঁদের জীবন-জীবিকার ক্ষতি হবে, তাঁরা কি পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন?
মাতারবাড়ীতে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিচার চলার ঘটনাও আমরা জানি। এমন অভিযোগ আর অনিয়ম কি বন্ধ হয়েছে? এসব সমস্যার মীমাংসা না হলে এতগুলো প্রকল্প একসঙ্গে চালানো কঠিন হবে।
মহেশখালীর মতো উপকূলীয় দ্বীপে এতগুলো প্রকল্প হলে তার কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। যেকোনো বিশেষ অঞ্চলে এমন ঝুঁকি থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন দেখভালের জন্য তাই একটি পরিষদ ও সংস্থা আছে। ভারতে সুন্দরবনের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় আছে। মুশকিল হচ্ছে, উপকূল আর দ্বীপ এলাকার অধিবাসীদের অধিকার, জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করার মতো সরকারি সংস্থা আমাদের নেই। আলাদা সংস্থা অথবা মন্ত্রণালয় হওয়া দরকার। উন্নয়ন-শিল্পায়নের সময় সে সংস্থা স্থানীয় পরিবেশ–প্রতিবেশ ও মানুষজনের স্বার্থ-অধিকারের নজরদারি করবে।
সাবেক বিদ্যুৎ–সচিব ও বড় প্রকল্প বিশেষজ্ঞ