৬৯ বছর ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি বা এফপিএবি। দেশের মোট সেবার ৪ শতাংশ দেয় এই প্রতিষ্ঠান।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের এই সাফল্যে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পাশাপাশি বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ ভূমিকা রেখেছে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এককভাবে বড় অবদান রেখেছে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি (এফপিএবি)।
এফপিএবির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। তখন এর নাম ছিল ফ্যামিলি প্লানিং অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তান। সে সময়ে পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল অস্পষ্ট, জন্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলা বা প্রচার করা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। এটা ছিল অনেকটা নিষিদ্ধ বিষয়ের মতো। তা ছাড়া মাঠপর্যায়ে সরকারের কোনো কর্মসূচি বা কাজ ছিল না। তখন থেকে গত ৬৯ বছর ধরেই সুখী ও সমৃদ্ধ পরিবার গড়ে তোলার কথা বলে চলেছে এফপিএবি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগে কাজের সময় অধ্যাপক হুমায়রা সায়ীদ লক্ষ করেন যে কম বয়সী মেয়েরা মা হয়ে প্রসবসেবা নিতে আসে, অনেক মা বারবার সন্তান নেন। মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, শিশুস্বাস্থ্য এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে হুমায়রা সায়ীদ কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজসেবীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান পরিবার পরিকল্পনা সমিতি গড়ে তোলেন। সমিতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমত, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে ছোট পরিবার ও পরিকল্পিত পরিবারের ধ্যানধারণাকে জনপ্রিয় করা, এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সামগ্রী সরবরাহ করা। দ্বিতীয়ত, জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারক ও জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি জানানো, যেন সরকার নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করে।
বর্তমানে ২৩টি জেলায় এফপিএবির শাখা আছে। এসব জেলায় ২১টি কেন্দ্রে সমন্বিত প্রজনন ও স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ৩টি বিশেষ ক্লিনিক ও ৪৮টি ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক পরিচালনা করা হয়। ৭২টি পরিবার উন্নয়নকেন্দ্রে নারীদের কর্মসংস্থান, লিঙ্গবৈষম্য দূর করা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করার মতো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে এফপিএবি। প্রতিষ্ঠানের ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত কর্মসূচিতে এফপিএবি পরিপূরক ও সম্পূরক ভূমিকা রেখেছে। দেশের মোট পরিবার পরিকল্পনা সেবার ৪ শতাংশ দেয় এই প্রতিষ্ঠান।
গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত একাধিক জনসংখ্যাবিষয়ক সম্মেলনে এফপিএবি জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা, পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরে। সরকার ১৯৬০ সালে সীমিত আকারে এবং ১৯৬৫ সালে সারা দেশে জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম শুরু করে। অর্থাৎ সরকারের আগেই পরিবার পরিকল্পনার কাজ শুরু করেছিল এফপিএবি।
স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানের নাম হয় বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি। স্বাধীন দেশের ১৯৭৬ সালে প্রথম জনসংখ্যা নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি জোরদার করার ক্ষেত্রে সরকারকে নীতিসহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের কাজ বড় করার চেষ্টা করে তারা।
জনসংখ্যাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের কান্ট্রি ডিরেক্টর ওবায়দুর রব প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিকে এফপিএবির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ক্লিনিক্যাল সেবা, অর্থাৎ স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি চালু করা ও জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনেক।’ উল্লেখ্য, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের পাশে প্রথম পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক স্থাপন করা হয়।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে এখন খোলামেলা আলোচনা করা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণের হার বেড়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভয়, কুসংস্কার, অস্পষ্টতা, অজ্ঞানতা অনেক কমেছে। তবে পরিস্থিতি এই অবস্থায় এক দিনে আসেনি। স্বাধীনতার আগেই মানুষের আচরণ পরিবর্তনের কাজটি শুরু করেছিল এফপিএবি।
ছোট পরিবারের সপক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য বাজারের থলে, হাতপাখা, তোয়ালে, দেশলাইয়ের বাক্সের ওপর ছোট পরিবারের ছবি আঁকা স্লোগান লেখা হতো। শুরু হয় পোস্টার ও প্রচারপত্র মুদ্রণ ও বিতরণ। এ সময় এফপিএবি পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে প্রথম তথ্যচিত্র তৈরি করে। ২০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রের নাম ছিল সাবধানের মার নেই। পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলনের এটি ছিল বড় মাইলফলক। এরপর ১৯৬৯ সালে সমিতি ‘সুখী পরিবার’ নামে ১৫ মিনিটের একটি রেডিও অনুষ্ঠান শুরু করে। স্বাধীনতার পর পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক প্রথম প্রকাশনা সুখী পরিবার প্রকাশ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
এফপিএবি সব সময় মনে করেছে, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সফল করতে হলে মানুষের আস্থা অর্জন ও সমর্থন দরকার। এ জন্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যম। এ জন্য সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয় তারা। ৩৩টি কর্মশালার মাধ্যমে প্রায় এক হাজার সাংবাদিককে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এফপিএবি। এরপর পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের সঙ্গে মতবিনিময় করে তারা। এই উদ্যোগের ফলে সংবাদপত্রে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে নানা সংবাদ যেমন ছাপা হতে থাকে, তেমনি সরকারি কার্যক্রমের ওপর সাংবাদিকদের নজরদারিও বাড়ে।
ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের কোনো বিরোধ নেই, এই বিষয়টি মানুষকে জানানোর জন্য ইমাম প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেয় এফপিএবি। ধর্মীয় নেতাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে যুক্ত করার লক্ষ্যে থানা (এখন উপজেলা) পর্যায়ে সেমিনারের আয়োজন করে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এফপিএবি তাদের কর্মকৌশলও পরিবর্তন করেছে। ১৯৯৪ সালে মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত প্রথম জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনে এবং ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলনে নতুন চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত হয় বিশ্ব। প্রজননস্বাস্থ্য, নারীকেন্দ্রিক উন্নয়ন, লিঙ্গসমতা, কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য ও সেবা—এসব বিষয় গুরুত্ব পেতে থাকে। এফপিএবিও এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনে। এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এফপিএবি সরকারকে সহায়তা করেছে, এখন এসডিজি অর্জনে সহায়তা করে চলেছে।