পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তরুণেরা, দূরত্ব বাড়ছে বাবা-মায়ের সঙ্গে। এই মতামত বড়দের না, তরুণদেরই। তারা যেমন পরিবার ও বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরত্ব নিয়ে চিন্তিত, তেমনি ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়েও রয়েছে দুশ্চিন্তা। আবার জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে তরুণেরা বাবা-মা বা পরিবার থেকেও যে খুব বেশি সহায়তা পাচ্ছে, তাও না।
জরিপে অংশ নিয়ে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণই বলেছে যে পরিবার ও বাবা-মায়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারাটাই তাদের জন্য সবচেয়ে চিন্তার বিষয়। ছেলে বা মেয়ে—সবার জন্যই এটি একটি বড় সমস্যা। এমনকি সব বয়সীরাও একই কথা বলেছে।
তবে তুলনামূলকভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা কম। যেমন পড়াশোনা শেষ করেছে এমন ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ বাবা-মায়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কথাটি বেশি বলেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর হার কিছুটা কম, ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
তরুণদের নিয়ে সারা বিশ্বেই এখন জরিপ পরিচালিত হচ্ছে। দেশেও গত দুই বছরের মধ্যে তরুণদের নিয়ে একাধিক জরিপ হয়েছে। এর আগের জরিপগুলোতে তরুণেরা প্রধান সমস্যা হিসেবে মূলত নিরাপত্তার অভাব বা চাকরি পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাই বেশি বলেছে। কিন্তু প্রথম আলোর উদ্যোগে পরিচালিত এই তারুণ্য
জরিপ-২০১৭-এ প্রথমবারের মতো উঠে এল পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে না পারার বিষয়টি। সমাজতত্ত্ব নিয়ে যাঁরা কাজ করেন বা মনস্তত্ত্ববিদেরা বেশ কিছুদিন ধরেই পারিবারিক বন্ধন এবং পারিবারিক মূল্যবোধকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে আসছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে তরুণেরাও একই বিষয় নিয়ে চিন্তিত। তরুণেরাও মনে করছে বাবা-মায়ের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ ক্রমে কমে যাচ্ছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সন্তানেরা এখন নিজেদের সমস্যা বাবা-মাকে আগের চেয়ে সহজে খুলে বলতে পারে, তবে এটি সব ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু একান্ত ব্যক্তিপর্যায়ের আলোচনাগুলো সন্তানেরা এখনো বাইরে বন্ধুবান্ধব বা অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে। সন্তানের যে আবেগপ্রবণ একটা জীবন ও পরিমণ্ডল আছে, সেখানে অভিভাবকদের অংশ নিতে হবে। সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের একটি মানসিক যোগাযোগ থাকতে হয়।
বাবা-মায়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ও পারিবারিক বন্ধন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাড়ানো কেন প্রয়োজন? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও
হাসপাতালের কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান তাজুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সন্তানদের বিপথে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে তারা নিজেদের সমস্যা পরিবারে তুলে ধরতে পারে না। তরুণেরা যৌনতা, নারী, মাদক, অপরাধ বা বাস্তব জীবনের ব্যাপারগুলো এখন বাইরের জগৎ থেকে শেখে। সেই জানার ক্ষেত্রে কেউ যদি খারাপ সংস্পর্শে চলে যায়, তাহলে সেটি তরুণদের জন্য খারাপ ফলাফল নিয়ে আসে। এসব শিক্ষা যদি পরিবারে দেওয়া যেত, তাহলে এই ভুল শিক্ষার অভিজ্ঞতা তাদের হতো না।
জীবনের লক্ষ্য নিয়েও দুশ্চিন্তা
প্রশ্ন ছিল আর কোন কোন বিষয়ে তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তা আছে? দেখা যাচ্ছে তরুণদের দ্বিতীয় সমস্যার নাম জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ঠিক করতে না পারা। স্কুলজীবনে ‘মাই এইম ইন লাইফ’ রচনা মুখস্থ করতে হলেও বাস্তব জীবনে তরুণদের বড় অংশই জানে না তাদের জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৩ দশমিক ১ শতাংশ এ কথা বলেছে। তবে উল্লেখযোগ্য দিক হলো মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা জীবনের লক্ষ্য নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। যেমন ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ ছেলে বলেছে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা তাদের জন্য একটি বড় সমস্যা, মেয়েদের মধ্যে এই হার ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ। একইভাবে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, অন্যরা তা নয়। যেমন ৮১ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও যারা এখন আর লেখাপড়ায় নেই, তাদের মধ্যে এ হার অনেক কম, ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ।
জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে নিশ্চিত না থাকার এ বিষয়টি জরিপের প্রথম পর্বে গতকাল রোববার উঠে এসেছিল। পরিবার ধরে আলোচনায়ও দেখা যাচ্ছে জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে তরুণেরা পরিবারের সহায়তাও পাচ্ছে না। কার কাছে যাবে, তাও জানে না তরুণেরা।
রাইসুল কবির একজন তরুণ উদ্যোক্তা। জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে উন্নতি করেছেন তিনি। গড়েছেন তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্রেইনস্টেশন ২৩। রাইসুল কবির মনে করেন, জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সন্তানদের সঠিক দিকনির্দেশনা অভিভাবকদের দিতে হবে। তবে সেটা কোনোভাবেই সন্তানের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে অনুপ্রেরণা হিসেবে যাতে কাজ করে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক পরিচর্যা ও অনুপ্রেরণা পেলেই সন্তান একসময় নিজেই তার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নিতে পারবে। আর তরুণদেরও কঠোর পরিশ্রম, প্রতিনিয়ত শেখা ও নতুন বিষয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। এই গুণাবলি থাকলেই জীবনের লক্ষ্য ঠিক করা কঠিন কিছু নয়।
তরুণদের আরও দুশ্চিন্তা
জরিপে দেখা যাচ্ছে, তরুণদের উদ্বেগ আছে ব্যক্তিগত বা নিজের নিরাপত্তা নিয়েও। ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ এ কথা বলেছে। তবে ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ ছেলে এটিকে সমস্যা মনে করলেও মেয়েদের মধ্যে এই ভাবনা অনেক বেশি, ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার বিষয়টি।
তরুণেরা এই যে পরিবার থেকে প্রয়োজনীয় পথের নির্দেশ পাচ্ছে না, পারিবারিক বন্ধন আলগা হওয়ায় বাড়ছে বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরত্ব, শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তানদের মধ্যে জঙ্গি হওয়াসহ নানা ধরনের বিপথে যাওয়ার প্রবণতার কারণ কি এগুলোও? তরুণদের মতামত থেকে এ প্রশ্নটাই উঠে এসেছে।
তরুণদের উদ্বেগ
বাবা–মার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা ৭২.৬ %
জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে না পারা ৬৩.১
ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ৫৬.৪
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ৩৮.৬
দুর্নীতি ৩৭.৪
কর্মসংস্থানের সুযোগ ৩৫.৩
পড়ালেখা ও পরীক্ষা ৩৪.৬
জঙ্গিবাদ ৩২.১